রিপন আনসারী: সকল আশংকাকে সত্য করে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হচ্ছে গাজীপুর। মরনঘাতি করোনা ভাইরাসে ঘিরে ফেলেছে এই জেলাকে। আমরা এখন মৃত্যুর কিনারে। আগ্নেগিরির আওতায় থাকা থাকা প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। ঘর থেকে বের হলেই মরণ। রাষ্ট্রের একজন বড় কর্তা বলেছিলেন, ঘরে থাকবেন না কবরে যাবেন সিদ্ধান্ত নিন। আজ সেটাই বাস্তব হল। গাজীপুর বাংলাদেশের নতুন সংক্রমন এলাকার মধ্যে প্রধান। হু হু করে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আমরা প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুর দিকে দাবিত। তবে যদি সতর্ক থাকি তবে সৃষ্টিকর্তা হয়ত আমাদের ক্ষমা করতে পারেন।
বিশ্লেষনে দেখা যায়, প্রথম দিকে গাজীপুর ভাল অবস্থানেই ছিল। কাপাসিয়াল একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে গাজীপুরে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। নারায়নগঞ্জ থেকে আসা করোনা রোগীর ছুঁয়ায় কাপাসিয়ার ছোঁয়া এগ্রো পুরো গাজীপুরকে ছুঁয়ে দিল। আজ আমরা আক্রান্ত। ভীষনভাবে আক্রান্ত। রাজধানী ঢাকার পরে নারায়ানগঞ্জ। আর আমরা তার পরেই। মানে নতুন সংক্রমন এলাকায় হিসেবে আমরা প্রথম আর সাধারণ হিসেবে আমরা তৃতীয় অবস্থানে আছি। গাজীপুরে এখন ২৬৮ জন রোগী। দিন দিন বাড়ছে। গাজীপুরে অর্ধশতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত। একই সমীকরণে পুলিশও আক্রান্ত। কনষ্টেল থেকে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত। যারা করোনা রোগীর চিকিৎসা করবেন তারা যদি আক্রান্ত হয় তবে বিপদ বড় ধরণের। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে যারা কাজ করবেন তারাই যদি আক্রান্ত হন, খোদ থানাই যদি লকডাউন হয়, তবে করা আমাদেরকে সচেতন করবে? সুতরাং বিপদ। যারা মানুষকে খবর দিবে তারাই যদি আক্রান্ত হয় তবে আরো বিপদ। সব ধরণের বিপদের মুখে গাজীপুর সহ পুরো বাংলাদেশ।
আজকে ধন্যবাদ দিতে হয়, গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে। তিনি সাহস করে একটি সত্য কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিয়েছেন। গার্মেন্টস মালিকরা করোনার সরঞ্জাম তৈরীর কথা বলে শ্রমিক দিয়ে অন্য পণ্য তৈরী করেন আর বেতন ভাতা দেন না। এই জন্য লকডাউন কার্যকর হয় না। আবরো অভিনন্দন এসপিকে। এটাই হলো আসল দেশপ্রেম। সত্য কথা বলে জাতিকে উদ্ধার করার চেষ্টা নিঃসন্দেহে সাহসী কাজ।
গাজীপুরে করোনার সংক্রমনের মূলে যদি যাই, তাহলে দেখা যাবে দুই দিক থেকে গাজীপুর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ব্যপকভাবে। প্রথমত নারায়ানগঞ্জ থেকে আসা করোনা রোগীর কাপাসিয়ার ছোঁয়া এগ্রোতে প্রবেশ।
দ্বিতীয়টি হল, শ্রীপুরে একই পরিবারের ৩জন আক্রান্ত হওয়ার উৎস। ওই তিন জনের একজন ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার মাষ্টারবাড়ি এলাকায় অবস্থিত একটি চীনা কারখানার শ্রমিক। শ্রীপুরের আরেকজন করোনা রোগীও একটি ফিড মিলের কর্মকর্তা।
সুতরাং গাজীপুরে করোনার সংক্রমনের উৎস শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটা পরিস্কার। আর এই ধারণাটা স্পষ্ট হল আজ গাজীপুরের পুলিশ সুপারের বক্তব্য থেকেও। কারণ তিনি যা বলেছেন, তাই সত্য। কারখানার মালিকেরা মিথ্য কথা বলে প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে বিনা বেতনে শ্রমিকদের কাজ করিয়ে ইচ্ছাকৃত শ্রমিক সমাবেশ ঘটানোর কারণেও করোনার সংক্রমন হতে পারে। যেহেতু গাজীপুরে করোনার উৎস শিল্প কারখানা সুতরাং এই জন্য সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানই দায়ী।
আমরা প্রথমেই বলেছিলাম, গাজীপুর অঘোষিত শিল্পরাজধানী। বাংলাদেশে যত শ্রমিক পোষাক কারাখানায় কাজ করেন তার অর্ধেক শ্রমিকের কর্মস্থল গাজীপুরে। এই বিশাল শ্রমিকের ভারে ভারসাম্যহীন গাজীপুরের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশ জড়িত। কারণ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলার কমবেশী লোকই গাজীপুরে কোন না কোন কাজ করেন। রাজধানী ঢাকায় কর্মরত অনেক লোক গাজীপুরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। সুতরাং আগে থেকেই আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল। আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা ফেল করেছি। কারণ মিথ্যা অজুহাতে খোলা রাখা পোষাক কারখানা গুলো বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আর ওই সব কারখানার মালিকেরা এই সময়ে শ্রমিকদের কাজ করিয়ে বেতন না দেয়ায় শ্রমিক আন্দোলন হওয়ায় সমাবেশ হয়েছে আর ওই সকল সমাবেশ থেকে করোনা সংক্রমিত হয়েছে এটা এখন আর গোপন নয়।
এসব কারণ ছাড়াও আরো একটি কারণ আছে বলতে হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, কোথাও করোনা শনাক্ত হলে লকডাউন করুন। আমরা দেখলাম ২জন করোনা রোগী নিয়ে রাজশাহী লকডাউন হয়েছে। আর আমরা লকডাউন হয়েছি ১১জন রোগী মাথায় নিয়ে। এখানে আমাদের আভ্যন্তরীন সমস্যা থাকতে পারে তবে মনে রাখা দরকার ছিল, বিশ্বমহামারিতে আক্রান্ত আমরা, এই সময়ে সব কিছু মনে রাখতে হয় না। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে যথা সময়ে লকডাউন করলে হয়ত আমরা এত বেশী আক্রান্ত নাও হতে পারতাম। তবে যাই হউক, যা গেছে গেছেই। এখন আমাদের উচিত হবে সামনে কি ভাবে করোনা মোকাবেলা করা যায়, সেই রাস্তা তৈরী করা।
বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুরে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য লকডাউন কার্যকরের বিকল্প নেই। এই লকডাউন কার্যকরের জন্য কি কি করা যায়, তা জরুরীভাবে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। সবাই এক সাথে বসে এই কাজটি করা দরকার।
সাধারণ মানুষ মনে করেন, ঘরে থাকার জন্য যা যা মৌলিক চাহিদা তা পূরণ করতে হবে। যাদের ত্রাণ দেয়া হবে তাদের খোলা মাঠে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ত্রাণ দিলে কমবেশী সমাবেশ ঘটবে আর সংক্রমনও বাড়বে। তাই মানুষকে ঘরে রেখে ত্রাণ দিতে হবে। আর যাদের ত্রাণ দরকার নেই তাদেরকে বাইরে পাওয়া গেলে আটক করে মামলা দিতে হবে। প্রয়োজনে কোয়ারেন্টিনের মত জায়গাকে কারাগার ঘোষনা করে কারাগারের আদলে কোয়ারেন্টিন করানো যেতে পারে। এই অবস্থায় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত একই পরিকল্পনায় আনতে হবে। কোন ভাবেই যেন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যেসকল শ্রমিক আন্দোলন করছেন বেতন ভাতার জন্য তাদের পাওনা প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দিয়ে দায়ী শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। বেসরকারী ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করে সকল ত্রাণ সংগ্রহ করার মাধ্যমে সম্পূর্নভাবে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌছাতে পারলে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। না হয় লকডাউন ফেল করলে আমরাও জীবনের সাথে হেরে যাবো এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তখন আমরা সবাই সবার হব। তাই চলেন এখনি সবাই সবার হই।