ওরা কোথায়! কি খাচ্ছেন, জানি তো?

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা


ঢাকা: ‘ম্যাডাম আমারে দেন, আমারে দেনগো ম্যাডাম…।’ একের পর এক আবদার। ফকিরাপুল থেকে কমলাপুরের দিকে যেতেই চোখে পড়ে ভাসমান মানুষের ভিড়। একটা প্রাইভেট কার থামতেই চারদিক ঘিরে ভিড় করে তারা। চাল, ডাল, তেল, পিয়াজসহ ত্রাণের কয়েক প্যাকেট দ্রুত বিতরণ করে গ্লাস নামিয়ে দেন এক নারী। ভিড় দেখে দ্রুত গাড়িটি স্থান ত্যাগ করে। কয়েক জন ত্রাণ পেয়ে বেশ খুশি। যারা পাননি তাদের মুখ বিমর্ষ। তাকানো যায় না।

দুপুরে মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ফটক সংলগ্ন ফুটপাতে ঘটে এই ঘটনা।

ফুটপাতে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি ঝুপড়ি ঘর। পলিথিন, কাপড়, কাগজ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি। এখানেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিন-রাত থাকেন নিন্ম আয়ের কিছু মানুষ। তাদের একজন আনসার মৃধা। আনসার মৃধার পাশে বসে রান্নার আয়োজন করছেন তার স্ত্রী। ওই নারী জানালেন, ফকিরাপুলের কাঁচাবাজার থেকে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু সবজি এনেছেন অল্প টাকা দিয়ে। সেগুলোই রান্না করবেন এখন। আগে তেমন রান্না করতে হতো না। গৃহরিচারিকার কাজ করেন তিনি। কাজ শেষে গৃহকর্ত্রী যে খাবার দিতেন তা দিয়েই স্বামী-সন্তানের দু’বেলা হয়ে যেতো। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে কাজ বন্ধ। গৃহকর্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, বাসায় না যেতে। একটি চায়ের দোকানে কাজ করতো তাদের ১২ বছরের ছেলে ফারুক। তারও দোকান বন্ধ। সারাদিন ফুটপাতে বসে, গল্প করে আর সাহায্যের আশায় সময় কাটে। বটি দিয়ে সবজি কাটতে কাটতে ওই নারী বললেন, বাজানগো এইভাবে কয়দিন চলবো। কী যে হইবো কিছুইতো বুঝি না।

নিরবে কথাগুলো শুনছিলেন তার স্বামী আনসার মৃধা। ঝুপড়ি ঘরের সামনের রাস্তায় একটি রিকশা থামানো। সেটি দেখিয়ে আনসার জানালেন, এই রিকশাটাই একমাত্র ভরসা। তাও এখন যাত্রী পাওয়া যায় না। মালিক এখন রিকশার ভাড়া নিচ্ছেন না। বলে দিয়েছেন, এই দুঃসময়ে ভাড়া লাগবে না। এটা চালিয়ে পেট চালাও। আনসার জানালেন, সকালে রিকশা নিয়ে বের হন। যাত্রী পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে অনেকেই বেশি দেন। তবুও কিছুতে কিছু হচ্ছে না।

পাশের ঝুপড়িতে দুই শিশু নিয়ে থাকেন এক নারী। জানালেন সকালে খেয়েছেন। রাতে একজন খাবার দিয়ে গেছে। কিন্তু দুপুরের খাবার নেই। ঘড়িতে তখন সাড়ে ১২টা, কী খাবেন তা জানেন না এই নারী। ঝুপড়ি ঘরের এই বসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওপারে টিএ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ফুটপাতেও অনেক বসতি ছিলো। লকডাউনের পর অসহায় হয়ে পড়ে তারা। রিকশা বন্ধ। দোকান বন্ধ। বেশ কয়েক দিন খেয়ে না খেয়ে থেকেছে অনেকেই। তারপর টাকা ধার করে পণ্যবাহী ট্রাকে করে বাড়িতে চলে গেছে।

ঠাকুরগাঁও’র আব্দুস শুকুর বলেন, ঢাকা শহর এরকম হবে তা কখনও ভাবিনি। কাজ-কাম নেই। সব বন্ধ। খাবারও নেই। শুকুর জানান, তারও বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পুলিশের ভয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন না। মহামারীর সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গেলে রোগ ছড়াতে পারে জানালে তিনি বলেন, আমরাতো রোগে মরব না। মরবোতো ক্ষুধায়। ঝুপড়ি ঘরের এই বাসিন্দারা জানান, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছে, এসব খেয়েই কোনোক্রমে ঠিকে আছেন তারা।

দেখা গেছে, একসময়ে ব্যস্ত কমলাপুর রেলস্টেশন অনেকটাই ফাঁকা। কোনো ভিড় নেই। স্টেশনের ভেতরে ভবঘুরেরা অন্য সময়ে থাকলেও এবার ভেতরে তাদের দেখা মেলেনি। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুল ইসলাম মানবজমিনকে জানান, স্টেশনের ভেতর থেকে তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের অংশ হিসেবেই এটি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আগে দুই থেকে তিন শ’ মানুষ রাতে আশ্রয় নিতেন এই স্টেশনে। তারা এখন কোথায় জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা অনেকে গ্রামে চলে গেছে। আবার অনেকেই ঢাকার বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে গেছে। ফুটপাতে থাকছে। তাদেরই একজন ১৪ বছর বয়সী নুর আলম। খিলগাঁও তালতলা এলাকার একটি সুপার শপের সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্য খুঁজছিলো পাঁচ-সাত কিশোর। তার মধ্যে ছিলো নুর আলম।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকার কথা বলা হলে আলম বলে, আমারতো ঘরই নাই। কই থাকুম। আলম জানায় তার বাড়ি ভোলা। বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে আগে থাকতো কড়াইল বন্তিতে। দুই বছর হয় মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তিনি বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। তারপর থেকে কমলাপুর, খিলগাঁও, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকে। কমলাপুরে কাজ করতো আলম। এখন কাজ নেই। তাই অন্যের খাবারের উপরই ভরসা। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য একজন তাকে একটি মাস্ক দিয়েছেন। সেটি ব্যবহার করছে সে।

আলমের সঙ্গী আরেক কিশোর আলাল জানায়, মতিঝিলে একটি বড় বিল্ডিয়ের নিচে থাকতো তারা কয়েক জন। করোনার কারণে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন দারোয়ান। এখন একেক দিন একেক স্থানে থাকতে হচ্ছে। সব চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে খাবারের। খাবারের দোকান বন্ধ। রান্না করা খাবার পাওয়া মুশকিল। আলাল বলে, সবাই শুধু চাল, ডাল আর টাকা দেয়। কিন্তু আমরা রান্না করব কই।

প্রায় ১৫ বছর যাবত স্ত্রীকে আর তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন রশিদ। আরামবাগ-নয়াপল্টনমুখী রাস্তার পূর্বপাশের ফুটপাতে তার ঝুপড়ি ঘর। মাটি কাটা, ইটভাঙ্গার মতো কায়িক শ্রমে চলছিলো তার সংসার। করোনাকালে চরম সঙ্কটে পড়েছে তার পরিবার। খেয়ে না খেয়ে কাটাচ্ছেন দিন রাত। জানালেন, কাজ নেই তাই সাহায্যের জন্যই পথ চেয়ে থাকতে হয় এখন।
হাইকোর্ট মাজার এলাকা, গুলিস্তান, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, মতিঝিল, খিলগাঁও, শাহবাগ, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এরকম অসংখ্য মানুষ। তাদের তাড়িয়ে দিলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাচ্ছে। নিজেদের নির্দিষ্ট কোনো বসতি নেই। তাই ফুটপাতেই আশ্রয় নিচ্ছে এসব মানুষ। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার হিসেব অনুসারে দেড় কোটির ওপরের জনসংখ্যার এই ঢাকার ফুটপাতে বাস করেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এছাড়া বস্তিতে থাকেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। তারা সবাই এই করোনাকালে প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *