হয়রানিমূলক এই মামলায়ই মতি ভাই’কে চেনায়

Slider জাতীয়

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা: এই লেখা লিখতে গিয়ে আমার প্রয়াত পিতা অলি আহাদের কথা মনে পড়ল। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বহুবার জেলে গেছেন তিনি। এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল এরশাদ সরকারের সময়। তখন ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু রিপোর্টের কারণে কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। ইত্তেহাদের প্রকাশনাও বন্ধ হয়েছে অসংখ্যবার।

বহুকাল পর মানবজমিন সম্পাদক মতি ভাইয়ের কাছে জানতে পারি সেসব রিপোর্টের কয়েকটিই তার করা ছিল, তিনি তখন কাজ করতেন ইত্তেহাদে। তার কাছেই জেনেছি তিনি নিজে রিপোর্টের দায়িত্ব নিতে চাইলেও অলি আহাদ সেটা করতে দিতেন না, বলতেন সম্পাদক যেহেতু তিনি দায়-দায়িত্ব তারই।

এই দেশের সব পেশার বহু মানুষের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর রোগ দেখা যায়-তরুণ বয়সের সাহস, সততা, আপোসহীনতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে যেতে পরিণত বয়সে প্রায় শেষই হয়ে যায়। এর মধ্যে হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম থাকে, তারই একজন মতি ভাই।

মতি ভাই মানবজমিনে সম্প্রতি প্রকাশিত লেখায় বিস্তারিত জানিয়েছেন দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে তিনি নানা সরকারের সময় বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হয়েছেন।

একের পর এক টার্ম অনির্বাচিত অবস্থায় ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে ২০১২/২০১৪ সাল থেকেই নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকার রাষ্ট্রের বাকি দুটো অঙ্গ আইন এবং বিচার বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সময় থেকেই সরকার একটা রাষ্ট্রের অলিখিত ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে।
এই চেষ্টায় কাউকে পদ-পদবী, জমি-ফ্ল্যাট, বিদেশ সফরের সঙ্গী করার মত কিছু সুবিধা দিয়ে, কাউকে প্রথমে আইসিটি অ্যাক্ট এবং পরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর মত নিবর্তনমূলক আইন এর ভীতি দেখিয়ে, কিংবা কাউকে সরকারি এবং বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে ‘ছলে-বলে-কৌশলে’ বশ মানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন অনির্বাচিতভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় থাকার কারণে এই ক্ষেত্রে সরকার প্রায় পুরোপুরি সফল-আজকের মিডিয়া দেখলে সেটা খুব ভালোভাবেই বোঝা যায়।

বিদ্যমান বীভৎস পরিস্থিতিতে হাতে গোনা দুই একটি পত্রিকা এখনো মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করে, এখনো মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সম্মান করে, সমর্থন দেয়। উদাহরণ দিতে গেলে সবার আগে সামনে আসবে মানবজমিনের নাম।

উপমহাদেশের প্রথম বাংলা ট্যাবলয়েড মানবজমিন। যদিও মতি ভাই এর ভাষায় ‘ট্যাবলয়েড বলতে যা বোঝায় তা আমরা করতে পারিনি। কারণ সমাজ অনুমতি দেয় না। আমাদের সমাজ কনজারভেটিভ’। আমার আবার মনে হয় মানবজমিনের সত্যিকারের ট্যাবলয়েড হয়ে উঠতে না পারা জনগণের জন্য শাপে বর হয়েছে। বহু ব্রডশিট পত্রিকা যে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, কিংবা করেনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেটাই করছে মানবজমিন অনেক দীর্ঘ সময় ধরে।
বর্তমান অনির্বাচিত টোটালিটারিয়ান সরকার তার বিরুদ্ধে কোন সত্য কথাও সহ্য করবে না এটাই স্বাভাবিক। অনুমান করি, নানাভাবে মতি ভাইকে বশে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা হয়ে ওঠেনি বলেই এখন এই মামলার খড়গ নেমে এসেছে।

সরকার যখন প্রথমে আইসিটি এবং পরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরি করে তখন অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন এর মধ্যে অনেকগুলো ধারার অপরাধ অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, যেটার সুযোগে যে কারো বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা যাবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি অপরাধের সংজ্ঞাকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে একেবারে পরিকল্পিতভাবে, যেন চাইলেই যে কাউকেই কোনো না কোনো অপরাধে অপরাধী বানিয়ে শায়েস্তা করা যায়। সাধারণ সচেতন মানুষ এখন জানে একই অপরাধে প্রথাগত মিডিয়ার ক্ষেত্রে যে শাস্তি হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে শাস্তি তার চাইতে অনেক বেশি রাখা হয়েছে।

মতি ভাইয়ের মামলা নিয়ে বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানহানির বিষয়ক মামলার বিরুদ্ধেই খুব দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। তারা বলেছে, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই মানহানির বিষয়টিকে অপরাধের আওতামুক্ত করতে হবে এবং আইনের পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে তা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’সহ মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে চলে। ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-এ স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশও’।

জানি, দেশের ভেতরের সচেতন মানুষ, বাইরের মানবাধিকার সংস্থা, কারো কোন আহ্বান/প্রতিবাদে কাজ হবে না। এই হয়রানির চেষ্টা চলতেই থাকবে। এটা শুধু মতি ভাইয়ের জন্যই ম্যাসেজ না, এই ঘটনা অন্যদের জন্য কাজ করবে ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’র মতো করে।

একটা টোটালিটারিয়ান সরকারের সময় যখন একে একে সব পেশার মানুষ নানা স্বার্থের কারণে সরকারের সাথে একাত্ম হয়ে যায় কিংবা হয়ে থাকে একেবারে নিশ্চুপ, তখনই একটি মানবজমিন, একজন মতি ভাই রুখে দাঁড়ান। অনিবার্যভাবেই তাকে বাধা দেয়া হবে নানা পন্থায়, যার মধ্যে মামলা একটি। এই মামলা তাকে হয়রানি করবে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এই মামলা আমাদেরকে আবার তার তার জাত চিনিয়ে দেবে, তা হল ‘কারও তাঁবেদারি করে না’। অনুমান করি তার এই জাতের কারণেই এটাকেই তিনি করেছেন মানবজমিনের স্লোগান।
(লেখক: সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *