মামলায় ছিলাম এবং আছি—– মতিউর রহমান চৌধুরী

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি


মামলা নতুন নয়। অসংখ্য মামলার মধ্যে আছি ছিলাম। তবে অভিনব একটি মামলা হয়েছে ৯ই মার্চ। একজন এমপি তার মানহানি হয়েছে বলে মানবজমিন-এর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলা তিনি করতেই পারেন। তার এই অধিকার রয়েছে। তিনি যদি আইন প্রণেতা না হয়ে অন্য কেউ হতেন তাহলে বোধ করি এ নিয়ে এতোটা সমালোচনা হতো না। দলমতনির্বিশেষে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা সোচ্চার হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো পাশে দাঁড়িয়েছে। জারি রেখেছে প্রতিবাদ। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই।

মানবজমিন। উপমহাদেশে প্রথম বাংলা ট্যাবলয়েড। ২২ বছর কেটে গেছে অনেক লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে। ট্যাবলয়েড বলতে যা বোঝায় তা আমরা করতে পারিনি। কারণ সমাজ অনুমতি দেয় না। আমাদের সমাজ কনজারভেটিভ। মামলা হয়েছে অনেক। এর মধ্যে ক্যাসেট কেলেঙ্কারির মামলা অন্যতম।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তখন প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হাইকোর্টের বিচারপতি লতিফুর রহমানের সঙ্গে একটি মামলা নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে নানা গুঞ্জন। বিষয়টি যায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কানে। মাহমুদুল ইসলাম তখন অ্যাটর্নি জেনারেল। কিছুকাল আগে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আইন বিষয়ে পণ্ডিত এই লোকটিকে যখন সাহাবুদ্দীন সাহেব আদালত অবমাননার মামলা করার নির্দেশ দিলেন তখন সময় নেননি। অতি দ্রুততার সঙ্গে আমার এবং মানবজমিন-এর সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। আসামি করা হলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। আদালতে এতো বড় মামলা কীভাবে মোকাবিলা করবো তা নিয়ে ভাবনার মধ্যে পড়ে গেলাম। মাথার উপরে বসতেন প্রয়াত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। দু’জনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা। মাঝে মধ্যে উপর তলায় গিয়ে আড্ডা দিতাম।

উপমহাদেশখ্যাত আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ মামলার কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন, প্রমাণ কি আছে? না-কি শুনেই রিপোর্ট করেছেন? প্রমাণ না থাকলে কিন্তু জেলে যেতেই হবে। তাছাড়া আমি নিজেও মামলা নেবো না। বললাম, বিচারপতি আর এরশাদ সাহেবের মধ্যেকার টেলি কথোপকথনের টেপ রয়েছে। অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন রোকনের সঙ্গে কথা বলে এই মামলা লড়বো। ঠিকই ব্রিফ তৈরি করলেন। ক্যাসেট শুনলেন দু’দফা।

ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ক্যাসেট শুনে বললেন আপনি কি গোয়েন্দা বাহিনীতে কাজ করেন নাকি! এই ক্যাসেট পেলেন কোথায়? আদালতে দুই প্রভাবশালী আইনজীবী মামলা লড়বেন শুনে মাহমুদুল ইসলাম ছুটে এলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের কাছে। স্যার এটা কি ঠিক আপনারা দাঁড়াচ্ছেন আসামিদের পক্ষে। ইশতিয়াক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন কেন? আপত্তি আছে? না স্যার, এসব মামলায় প্রমাণ ছাড়া কি আপনাদের মতো আইনজীবী দাঁড়াতে পারেন? দেখা যাক, আদালতেই দেখা হবে।

মামলা উঠলো আদালতে। বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ও বিচারপতি এ, কে, এম শফিউদ্দিন প্রথমেই জানতে চাইলেন কিসের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট করা হয়েছে? এরশাদ সাহেব যে বিচারপতি লতিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন এর দালিলিক প্রমাণ কি? ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বললেন, আমরা এখনই প্রমাণ হাজির করবো। ক্যাসেট দেখিয়ে বললেন, এটাতে প্রমাণ বন্দি করা আছে। আদালত চত্বর তখন আইনজীবীতে ঠাসা। কৌতূহলী মানুষজনেরও ভিড়। আদালতের কার্যক্রম এক ঘণ্টার জন্য স্থগিত করা হলো।
ক্যাসেট রেকর্ডার আগেই বাসা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যাসেট শুনলেন বিচারপতি প্যানেল ও আইনজীবীরা। বিচারপতির কণ্ঠ শুনে সহকর্মীরা নিশ্চিত হলেন। আর এরশাদ সাহেবের কণ্ঠ তো সবার চেনা। সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি লতিফুর রহমান পদত্যাগ করলেন। মামলা চলতে থাকলো। রায়ে এরশাদ সাহেবের ছয় মাসের জেল। আমার ১ মাস। মাহবুবা চৌধুরীর ১ দিন। আদালতে প্রমাণ হাজির করেও জেল কেন হলো এই প্রশ্নের কোনো জবাব পাইনি। এমন কি বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলামকে অবসরকালীন সময়ে এক অনুষ্ঠানে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনিও জবাবটা এড়িয়ে যান। মামলাটি এখন পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

যাই হোক, মামলা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। জীবনে মামলা মোকাবিলা করেছি অনেক। চাকরি হারিয়েছি ’৭৪ সনে। খালেদা জিয়ার জমানায় জেলে গিয়েছি। ১৭ ঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য লেখার কারণে আমার গাড়িও ভেঙে দিয়েছিল এরশাদ সাহেবের লোকেরা। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের জমানায় দু’বার অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়। একনাগাড়ে বিনা কারণে আট মাস বাইরে থাকার দুঃখজনক অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ছাত্র-রাজনীতি থেকে সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। রাজনীতি করলে কিছু একটা হতে পারতাম। আমার বন্ধুরা তো হয়েছেন। রাজনীতি করার ইচ্ছে কখনো ছিল না। এখনো নেই। কোনো দলে ভিড়ি নাই। কোনো ফোরাম বৈঠকেও যাই না। সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করি। খারাপ কাজের সমালোচনা করলে অনেকে ক্ষুব্ধ হন। দলভুক্ত করার চেষ্টা করেন।

বিএনপি’র শাসনকালে কেবলমাত্র ‘মানবজমিন’ লিখেছিল ৬ জন মন্ত্রী ছাড়া বাকিদের গায়ে ময়লা লেগেছে। আসলে ৫০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে কারো লোক হতে পারলাম না। মাগুরা-১ এর এমপি সাইফুজ্জামান শিখর মামলা করেছেন। শিখরের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কোনোদিন ফোনেও কথা হয়নি। তবে তার বাবা এডভোকেট আসাদুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাকে নিয়ে অনেক লিখেছি। একজন সৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি সচ্ছল রাজনীতিবিদ ছিলেন না। মানুষ তাকে ভালোবাসতো প্রাণভরে। অনেক কষ্ট করে গেছেন। রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন।

আমি তখন বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক। তাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। ‘একজন আসাদুজ্জামানের মৃত্যু’। শিখরের পরিবারের কাছে আমার এই লেখাটি অনেকদিন সযত্নে রাখা ছিল। দলের জন্য অনেক কিছু করলেও আসাদুজ্জামান সাহেব সুখ দেখে যাননি। মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা আগেও ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ তিনি ছিলেন সৎ রাজনীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সাইফুজ্জামান শিখর মামলা করেছেন। মামলা চললে আদালতে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করবো। আইন যদি সত্যিকার অর্থে তার নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে আমরা ন্যায়বিচার পাবো- এটা আশা রাখি। একটা কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, আইন করে যেমন কাউকে দায়িত্বশীল করা যায় না। তেমনি আইন কারো মানও ফিরিয়ে দিতে পারে না। মানহানি থেকে সুরক্ষা সব দেশের আইনেই থাকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য একটি আলাদা সত্য রয়েছে। সেটি হলো তাদের মান-মর্যাদার বিষয়টি আইন দ্বারা নয়, সেটা বহুলাংশে পাবলিক পারসেপশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *