তেহরান জনসমুদ্রে বদলার হুংকার

Slider জাতীয় সারাবিশ্ব

ডেস্ক: ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির হত্যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। যুদ্ধের হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্যে ইরানের রাজধানী তেহরানে সোমবার সোলাইমানির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জনতার ঢল নামে। শোকার্ত জনসমুদ্রে তার জানাজা পড়ান দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তার সঙ্গে মাতম করতে দেখা যায় লাখো মানুষকে। এ সময় শোকার্ত জনতার মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চরম বদলা নেওয়ার আওয়াজ ওঠে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুংকার দিয়ে রেখেছেন, তার দেশের কোনো নাগরিক বা সম্পদের ওপর হামলা হলে ধ্বংসাত্মক জবাব দেওয়া হবে ইরানকে, যা তারা ভাবতেও পারে না।

সোলাইমানি ইরানে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। সর্বোচ্চ নেতা খামেনির পর দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে দেখা হতো সোলাইমানিকে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় তার সঙ্গে নিহত হন ইরাকের শীর্ষ মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহানদিস। গতকাল তেহরানে সোলাইমানির কফিনের পাশে ছিল তার কফিনও। ওই হামলায় নিহত অন্যদের কফিনও রাখা ছিল সেখানে। তেহরানে জানাজার পর সোলাইমানির মরদেহ পবিত্র শহর কওমে নিয়ে যাওয়ার কথা। আজ মঙ্গলবার কেরমানে গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হবে। তেহরানে সোলাইমানির জানাজায় অংশ নেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া।

সোলাইমানির জানাজায় মানুষকে কাঁদতে দেখা গেছে। কেউ কেউ সোলেইমানির ছবি আঁকড়ে ধরে ছিলেন। মানুষ সোলাইমানির কফিন সামনে রেখে ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। সোলাইমানির মেয়ে জয়নাব সোলাইমানি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কালো দিন অপেক্ষা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘পাগল’ সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘আপনি ভাববেন না যে, আমার বাবার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। আপনার জন্য অন্ধকার দিন অপেক্ষা করছে।’

সোলাইমানির জানাজা থেকে ট্রাম্পের মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে আট কোটি ডলার। ইরানের একটি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, দেশটির শীর্ষ জেনারেলকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের মাথার মূল্য ঘোষণাসহ হোয়াইট হাউসে হামলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

এদিকে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। ২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক এই চুক্তি হয়েছিল ইরানের। রোববার পার্লামেন্টে এক বৈঠকের পর এ ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। তবে ইরানের এ ঘোষণায় হতাশা প্রকাশ করেছেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করা অন্য দেশের নেতারা। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রোববার এক যৌথ বিবৃতিতে ইরানকে তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া উত্তেজনা প্রশমন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিশ্নেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় আগামী ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হবে ইরান।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ ঠেকাতে তোড়জোড় শুরু করেছে বিশ্বশক্তি। দেশ দুটির হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ায় আশঙ্কায় নড়েচড়ে বসেছে রাশিয়া থেকে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে জাতিসংঘ। সবাই তেহরান-ওয়াশিংটনকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটো গতকাল ব্রাসেলসে জরুরি বৈঠক করেছে। তারা প্রতিশোধমূলক হামলা বা উস্কানি থেকে বিরত থাকতে ইরানকে সতর্ক করেছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করতে শুক্রবার জরুরি বৈঠকে বসছেন ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানও যুদ্ধের ‘ভয়ংকর উন্মাদনা’ থেকে উভয়কে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। চীনও যুদ্ধ চায় না।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বান্ধবীকে নিয়ে ছুটি কাটানো শেষে দেশে ফিরে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন করেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ইরানের হামলার শিকার হতে পারে বলে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। ইরানের সীমান্তসংলগ্ন দেশ হওয়ায় উত্তেজনার আঁচ পড়েছে পাকিস্তানেও। গতকাল দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বলেছেন, যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র বা ইরান- কোনো পক্ষই নেবে না পাকিস্তান।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বের করে দেওয়ার বিষয়ে রোববার ইরাকের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর বাগদাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই দিন ফ্লোরিডা থেকে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি যাওয়ার পথে ট্রাম্পকে বহনকারী বিমান ‘এয়ারফোর্স ওয়ানে’ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এ হুমকি দেন তিনি।

সোলাইমানি হত্যাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। যুদ্ধের দামামাও বাজছে। সেই অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাজার ব্যবস্থায়। লাঠি বেয়ে বানরের ওঠানামা অবস্থা ওয়াল স্ট্রিট থেকে হংকংয়ের মতো বড় পুঁজিবাজারের। এর প্রভাবে তেল ও স্বর্ণের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সোলাইমানিকে হত্যার পরদিনই ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কায় বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রায় ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই কারণে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্বর্ণের দাম। সূত্র :এএফপি, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *