কেরানীগঞ্জ ট্র্যাজেডি: এক দিনেই দগ্ধ ৫ জনের মৃত্যু, মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৯

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি


ঢাকা: ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পঁচাত্তর ঘণ্টার মাথায় বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাকও (৪৫) মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় তার ছোট ভাই আলমগীর ওরফে আলম হোসেন (৩৫) মারা যান বার্ন ইউনিটে।

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছিলেন তারা। শ্রমিক ছিলেন তারা ওই কারখানার। রাজ্জাকসহ রোববার পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। অন্য চারজন হলেন ইলেকট্রিশিয়ান আবু সাঈদ (১৭), শ্রমিক মোস্তাকিম (২২), সুমন হাওলাদার (২২) ও দুর্জয় দাস (১৮)।

কারখানার অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হলো। এখনও দগ্ধ ১৩ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন।

বুধবার বিকেলে চুনকুটিয়ায় প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কারখানা ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজে’ আগুন লাগে। এতে ৩৫ জন দগ্ধ হন। এর মধ্যে ৩১ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরে ১০ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। দগ্ধ সবার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় মোস্তাকিম, সাড়ে ৯টায় রাজ্জাক, সাড়ে ১১টায় সাঈদ ও সন্ধ্যায় সুমনের মৃত্যু হয়। তারা লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যু হলো। এ ছাড়া রোববার সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার বাড়িতে মারা যান দুর্জয় দাস। এর আগে ঘটনার দিন ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৯ জন।

দুর্জয়ের বাবা পিন্টু দাস জানান, তার ছেলে দুর্জয় কারাখানার শ্রমিক ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডে দুর্জয়ের পুরো শরীর দগ্ধ হয়ে যায়। বুধবার রাতে তাকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল। ছেলের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে চিকিৎসক তাকে জানিয়েছিলেন। ছেলের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না বলে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যান। রোববার সন্ধ্যা ৬টায় দুর্জয়ের মৃত্যু হয়।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, রোববার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মোস্তাকিমের শরীরের ২০ শতাংশ, সাঈদের ৮০ শতাংশ, সুমনের ৫০ শতাংশ ও রাজ্জাকের পুরো শরীর দগ্ধ হয়েছিল। আইসিইউতে আরও পাঁচজন এবং বার্ন ইউনিটে আটজন চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানান তিনি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মোস্তাকিমের বাবার নাম মুন্তাজ আলী। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর ঋষিপুরে। মোস্তাকিমের মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ওই কারখানার শ্রমিক ছিল। কারখানার পাশের একটি মেসে বসবাস করত।’

আবু সাঈদের বাবা নাম শামীম দেওয়ান ফেরি করে গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী এলাকায় কাপড় বিক্রি করেন। সাঈদ কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। সুমনের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। থাকতেন কেরানীগঞ্জের হাবিব নগরে।

আব্দুর রাজ্জাকের ভগ্নিপতি কোরবানী আলী জানান, রাজ্জাকরা চার ভাই ও তিন বোন। এর মধ্যে দুই ভাই রাজ্জাক ও আলম ওই কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। তাদের বাসা কেরানীগঞ্জের হিজলতলায়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান তারা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান আলম এবং রোববার সকালে রাজ্জাকের মৃত্যু হয়েছে। দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে স্বজনদের মধ্যে। রাজ্জাকের একমাত্র সন্তান আয়েশা আক্তার টুম্পাকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লেন স্ত্রী গুলশান আরা। ৬-৭ হাজার টাকা বেতনে কোনো রকমে রাজ্জাকের সংসার চলত। মাসের টাকা মাসেই খরচ হয়ে যেত। গচ্ছিত কোনো টাকা নেই তার সংসারে। এখন মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী কীভাবে চলবেন? অভাবে মেয়ের পড়ালেখাও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।

রাজ্জাকের মৃত্যুর আগের দিন শনিবার স্ত্রী গুলশান আরা বলেন, বৃহস্পতিবার আলম মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সবাই বলেছিল তার স্বামী মারা গেছেন। কিন্তু সবার দোয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার প্রার্থনাও করেন তিনি। রোববার স্বামীর মৃত্যুর পর গুলশান আরা হাসপাতাল চত্বরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর্তনাদ করে বলেন, ‘স্বামীকে বাঁচাতে পারলাম না। আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *