মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) হাজিরা দেয়ার অং সান সুচির সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্যের কূটনীতিকরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যে, তিনি খুবই বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করেছেন, তারা তাকে সিদ্ধান্তটি পুনঃবিবেচনা করতে বলছেন। তবে মিয়ানমারের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, এমপি ও নাগরিক সমাজ হয় তাকে উচ্চকণ্ঠে সমর্থন করছেন কিংবা হিসাবি সমর্থন দিচ্ছেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে গত তিন বছর ধরে মুসলিম জনসংখ্যার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ও দেশটির সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে। এসব শুদ্ধি অভিযানের ফলে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন। আদালতে নিজেই হাজির হওয়ার সুচির পদক্ষেপটি দেশটির বেশির ভাগ লোকের কাছে বিস্ময়কর ঘটনা বলে মনে হলেও বিদেশী কূটনীতিকরা মনে করছেন, এটি হয়ে গেছে খুবই দ্রুত। স্টেট কাউন্সিলরের পরিকল্পিত সফরটির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুন ও অন্যান্য নগরকেন্দ্রে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ সমর্থনসূচক সমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। ১০ ডিসেম্বরের শুনানির আগে আরো কিছু সমাবেশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সারা দেশেই সুচির প্রতি সমর্থন বাড়ছে।
ইয়াঙ্গুনসহ বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে লেখা শোভা পাচ্ছে, ‘মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আসুন আমরা স্টেট কাউন্সিলরের সাথে ঐক্যবদ্ধ হই।’ আবার নগর পরিবহন নেটওয়ার্কে তিন জেনারেলের সামনে সুচিকে দাঁড়ানো ছবি একই বার্তা দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আমরা আছি আপনার সাথে।’ স্টেট কাউন্সিলরের প্রতি সমর্থন দিতে কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্ট নেদারল্যান্ডসে ৫ দিনের ট্যুর প্যাকেজের কথা ঘোষণা করছে।
এক সপ্তাহ আগে সাহসী ঘোষণা সত্ত্বেও সুচির সফরটি নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ কূটনৈতিক দায়মুক্তি, ভ্রমণ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে। সুচি যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আদালতে হাজির হওয়ার পরিকল্পনা করছেন, কিন্তু তিনি তো বাস্তবে সেখানে যাচ্ছেন ‘ব্যক্তিগত পরিচিতিতে।’ নেদারল্যান্ডস তাকে আমন্ত্রণ জানায়নি, ফলে এটা সরকারি সফর হবে না। আবার তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রটোকল দেয়া হবে না সাধারণ প্রটোকল দেয়া হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আবার আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি পর্যাপ্ত সুরক্ষা পাবেন কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে। তাছাড়া তিনি কিভাবে দি হেগে যাবেন, তা নিয়েও জটিলতা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে হেগে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। তবে বিমান ভাড়া করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে।
কূটনীতিকরা তাকে বারণ করলেও সুচি কিন্তু সফরটির ব্যাপারে অনড়। পাশ্চাত্যের কূটনীতিকরা তাকে বোঝাতে চাইছে যে আদালতে তিনি হাজির হলে দেশের আন্তর্জাতিক সুনামে ধস নামতে পারে। সুচি বা সামরিক বাহিনী যদি যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত নিধন ও গণহত্যায় জড়িত বলে প্রমাণিত হয়, তবে তা হবে মিয়ানমারের জন্য ভয়াবহ অবস্থা। গণহত্যার অভিযোগ ওঠেছে ২০১৬ থেকে। ওই বছরের অক্টোবরে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি সীমান্ত চৌকির ওপর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) অপ্রত্যাশিত হামলার পর বড় ধরনের সেনা অভিযান শুরু হয়। এর ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
তারপর ২০১৭ সালের আগস্টে আরসার আবারো হামলা ঘটে। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী আরো কঠোর অভিযান চালায়। এতে আরো বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। জাতিসংঘ প্রতিবেদনগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনী দৃঢ়ভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম দেশ গাম্বিয়া ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম লোকজনের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ দায়ের করে। মিয়ানমার জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে কিনা তা তদন্ত করার জন্য আইসিজের প্রতি আহ্বান জানায় গাম্বিয়া। এই চুক্তিতে সই-কারী হওয়ায় মিয়ানমারের পক্ষে এই শুনানি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
সুচি ও তার প্রশাসন মনে করছে, এই মামলার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তার দেশের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা সরাসরি তাদের অবস্থান তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের বেশ কয়েকজন সিনিয়র সদস্য সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, রাখাইন রাজ্যে যা ঘটেছে তা গণহত্যা বা জাতিগত নিধন অভিযান নয়। বরং সন্ত্রাস প্রতিরোধে এটি একটি আদর্শ মানদন্ড। সরকার আশা করছে, তারা ভালোভাবেই তাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারবে। তবে সরকারের বোঝা উচিত যে, তারা কোনো ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ করেছিল কিনা তা বিচার করা হবে। আর রাখাইন রাজ্যে বৈষম্য ও সংঘাত অবসানের মূল কারণ সমাধানে তারা সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিনা তাও বিশ্লেষণ করা হবে। এখানে বাগাড়ম্বড়তা পর্যাপ্ত বিবেচিত হবে না। বিপদের বিষয় হলো, মিয়ানমার পক্ষ এই আন্তর্জাতিক আদালতের প্রকৃতি বোঝে না।
আইসিজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাবেক এক জার্মান কূটনীতিক বলেন, এটা বিচার নয়, বরং এখতিয়ারের বিষয়। এটি কোনো ফৌজদারি আদালত নয়। এটি কোনো শাস্তি দিতে পারে না। এখানে সাক্ষীদের জেরা করা হয় না। আইসিজে পক্ষগুলোর মধ্যে বিচার করে। এখানে দুই পক্ষ হলো মিয়ানমার ও গাম্বিয়া। এখানে আইনগত বিষয়ই হবে আসল কথা। উভয় পক্ষেই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী থাকবেন। উভয় দেশই আলাদা আলাদা দিনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে। আর মামলাটি শেষও একদিনে হবে না। এতে ১০ বছর লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো দুটি আন্তর্জাতিক মামলা রয়েছে। একটি দি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ও অপরটি আর্জেন্টিনায়। তবে মিয়ানমারের এই অবিসংবাদিত নেত্রীকে আসলে আদালতের বাইরে আন্তর্জাতিক জনমতের কাছে আরো বড় পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। দি হেগে আসলে তার এই জবাবদিহিতা শুরু। এমন আশঙ্কাও রয়েছে, এটা করতে গিয়ে তিনি অসাবধানতায় নিজেকে এবং সেইসাথে তার বেসামরিক সরকারকেও দোষী সাব্যস্ত করে ফেলবেন।
যাই হোক, দি হেগের শুনানি আসলে গল্পের শেষ নয়, বরং দীর্ঘ পথের সূচনা মাত্র।
(অনলাইন সাউথ এশিয়ান মনিটরে প্রকাশিত প্রতিবেদন)