চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। পরিচয় দেন বেসরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা। আবার কখনো বড় ব্যবসায়ী। টার্গেট করেন ডিভোর্সি আত্মনির্ভরশীল নারীদের। যাদের ব্যাংকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার আছে। পরে ফাঁদ পাতেন ফেসবুকে। টার্গেট করা নারীকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। মিথ্যা কথায় কৌশলে গড়ে তুলেন প্রেমের সম্পর্ক।
গভীর প্রেমে মগ্ন করে মিথ্যা কাবিন নামায় বিয়ে করেন। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। ওই নারীর সব লুটে নেয়ার আগ পর্যন্ত থাকে সম্পর্ক। যখন বুঝতে পারেন তার কাছে আর কিছু নেই তখন সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। এরপর পরবর্তী টার্গেট ধরার চেষ্টা করেন। এভাবেই এক এক করে অন্তত ২৮৭ জন নারীর সঙ্গে বিয়ের নাটক করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারণার শিকার হয়ে কত নারী যে নিঃস্ব হয়েছেন তার হিসাব নেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি এ যুবকের। এক নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তেজগাঁও থানা পুলিশ জাকির হোসেন ব্যাপারী নামের ওই প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে সে অকপটে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে প্রতারণার কথা স্বীকার করছে। পুলিশ তাকে আদালতে হাজির রিমান্ড আবেদন করেছিলো।
আদালতের নির্দেশে জাকির এখন দুই দিনের রিমান্ডে আছে। বিয়ে প্রতারক জাকির বেপারীর প্রতারণার শিকার হয়ে বুধবার জান্নাত (ছদ্মনাম) নামের এক নারীর মামলায়ই জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক তৌফিক আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, প্রায় একই কৌশলে এই প্রতারক সমাজের উচ্চ বিত্ত, আত্মনির্ভরশীল, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী নারীদেরকে টার্গেট করতেন। ভুয়া নাম দিয়ে ফেসবুক একাউন্ট খুলে সুন্দরী নারীদের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতেন। আবার নিজেকে বড় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও মিথ্যা ব্যক্তিগত তথ্য উল্লেখ করে ফেসবুকে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিতেন। এসব দেখে অনেক নারী নিজে থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আবার কোনো নারী যদি তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট না করত তবে তার মেসেঞ্জারে মেসেজ দিতেন। এরপর শুরু হত তার সঙ্গে প্রেমের আলাপ। মোবাইল নম্বর এনে কথা বলতেন রাত দিন। মিষ্টি কথা বলে তার প্রতি দুর্বল করতেন নারীদের। দামি গাড়ি নিয়ে দেখা করতেন। খাওয়া দাওয়া করতেন দামি রেস্তরায়। নারীদের কাছে নিজেকে এতিম বলে দাবি করতেন। আকৃষ্ট করার জন্য নারীদের বলতেন তার বগুড়ায় ছয় তলা বাড়ি, ঢাকায় প্লট, ফ্ল্যাট আছে। যখন বুঝতে পারতেন নারীরা তার প্রতি পুরো দুর্বল হয়ে গেছেন তখন বিয়ের প্রস্তাব দিতেন।
একপর্যায়ে ভুয়া কাজী দিয়ে মিথ্যা কাবিননামায় বিয়ে করতেন। বিয়ের পরই শুরু হত তার আসল মিশন। ফন্দি আটতেন কিভাবে টাকা আদায় করা যায়। প্রাথমিক কৌশল হিসাবে ওই নারীর বাবা মায়ের কাছে বিয়ে পরবর্তী দোয়া নেয়ার জন্য দেখা করতে যেতেন। জানতেন নতুন জামাইকে বরণ করে তার শশুর-শাশুড়ী নানা উপহার দিবেন। তাই হত! নগদ টাকা, স্বর্ণের আংটি, গলার চেইনসহ নানা উপহার পেতেন। এরপর কৌশলে স্ত্রীর সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ছবি বা ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। কিছু দিন যাবার পর তার আসল চেহেরা ফুটে উঠত। সেই ভিডিও দিয়ে শুরু করতেন ব্ল্যাকমেইলিং। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করতেন টাকা। এস আই তৌফিক বলেন, এই প্রতারক সবকিছু খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করত। পরিচয় থেকে শুরু করে প্রেম, বিয়ে এবং ছাড়াছাড়ি সবকিছুতে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে করত। তার কৌশলের কাছে সহজ-সরল নারীরা হার মানতেন। যখন বুঝতে পারতেন বা ধরা পড়তো তার প্রতারণা তখন হয়তো অনেক দেরী হয়ে যেত। মান সম্মানের ভয়ে অনেক নারীই তাদের পরিবার এমনকি থানা পুলিশের কাছে এসব বিষয়ে অভিযোগ করতেন না।
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, প্রতারক জাকির হোসেন বেপারীর বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী জেলার দুর্গাপুরে। ২০০৫ সালে সে শাপলা বেগম নামের এক নারীকে সর্বপ্রথম বিয়ে করে। ওই নারীর সঙ্গে তার এখনও সংসার আছে। তার বাবা মা বেচে নাই। দুই ভাই ও এক বোন থাকলেও ভাইদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নাই। তার প্রতারণা শিকার হয়ে অন্তত ২০ জনের মত নারী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। অনেকেই মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা তাকে দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। অনেক নারীর সঙ্গে প্রতারণার কথা সে স্বীকার করেছে। এছাড়া একাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করার বেশ কিছু তথ্য প্রমাণও আমরা পেয়েছি। যতটুকু জানতে পেরেছি একসময় পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসাবে সে কাজ করত। সেখানে নারীদের সঙ্গে কেলেঙ্কারি করায় তার চাকরি চলে যায়। তারপর থেকেই পেশা হিসাবেই এ পথকে বেছে নেয়। গতবছর মিরপুরের এক নারীর সঙ্গে বিয়ে প্রতারণা করে টাকা-স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়ার জন্য ওই নারী মামলা করেছিলেন। পরে ওই মামলায় সে ৬ মাসের জেল খেটেছে। জামিনে জেল থেকে বের হয়ে ফের একই কাজ শুরু করে। এই কাজে তাকে সহযোগীতা করে ৫/৬ জন। এরমধ্যে তার প্রথম স্ত্রী আছে। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে ভুয়া কাজী, বিয়েতে যারা সাক্ষী হত আর তার বোনকে। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। সে কোন নারীর সঙ্গে কি করেছে। কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখবো।
ভুক্তভোগী নারীরা যা বলছেন: বিয়ে প্রতারক জাকির হোসেন বেপারী গ্রেপ্তার হয়েছেন এমন খবরে তার প্রতারণার শিকার অনেক নারীই তাকে দেখার জন্য তেজগাঁও থানায় আসছেন। অনেক নারীই তাদের সঙ্গে প্রতারণা নিয়ে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। মিরপুরের বাসিন্দা ও পোশাক ব্যবসায়ী রিমি (ছদ্মনাম) বলেন, আমার সঙ্গে প্রতারক জাকির যা করেছে তা সত্যিই অমানবিক। সে আমাকে বিয়েই করেনি অথচ ভুয়া কাজী দিয়ে মিথ্যা বিয়ের নাটক করে আমার কাছ থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার নগদ টাকা, ১ ভরি স্বর্ণের গহনা, ১টি আংটি নিয়েছে। হিসাবের বাইরে সে বিভিন্ন অজুহাতে আমার কাছ থেকে আরো অনেক টাকা নিয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। জাকির আমাকে প্রথমে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলো। কিন্তু আমি সেটি একসেপ্ট করি নাই। পরে সে আমাকে মেসেঞ্জারে মেসেজ করে। একপর্যায়ে তার সঙ্গে আমার কথা শুরু হয়। কিছুদিন যাবার পরই সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার প্রস্তাবে আমিও রাজি হয়ে যাই। কারণ তার চলাফেরা কথাবার্তা সবই আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো। নিজেকে সে বনানী কেডিএস নামের একটি কোম্পানির জিএম হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলো।
এছাড়া একটা নারী আকৃষ্ট হওয়ার জন্য যা করার দরকার ছিল সবই করতো। গত বছরের কোরবানি ঈদের রাতে আমার বাসায় এসে সে আমাকে বিয়ে করে। তারপর সে আমার বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে অনেক উপহারও দেয়া হয়। তারপর সেখান থেকে ঢাকায় এসে আমার বাসায় উঠে। দুদিন যাবার পর থেকে সে আমার কাছে থেকে টাকা, মোবাইল ও স্বর্ণালঙ্কার নেয়ার জন্য নানা ফন্দি পাতে। রিমি বলেন, একই বাসায় থাকার সুবাদে সে বিভিন্ন সময় কৌশলে আমার কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও করে নেয়। যেটি আমি জানতামও না। পরবর্তীতে যখন তার সঙ্গে টাকা পয়সা নিয়ে আমার মনোমালিণ্য সৃষ্টি হয় তখন সে অন্তরঙ্গ ওই ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এমনকি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। টাকার জন্য আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে। পরে বাধ্য হয়ে আমি থানায় মামলা করি।
ভুক্তভোগী জান্নাত বলেন, ৩১শে অক্টোবর ফেসবুকের মাধ্যমেই জাকিরের সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে বিভিন্ন সময় কথা হত। পরিচয়ের পর সে তার পরিবারের সঙ্গে আমার কথা বলিয়ে দেয়। এক সময় দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। জাকিরের বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে যাই। ৭ই নভেম্বর সে আমাকে আমার হোস্টেল থেকে শ্যামলী এলাকায় নিয়ে কাজী ও ১ জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে করে। ওই দিনই সে আমার বাবা মাকে বিয়ের কথা জানানোর জন্য আমাকে নিয়ে আমার বাড়িতে যায়। আমার বাবা তাকে ২৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি আংটি ও তার পোশাক কেনার জন্য আরও ২০ হাজার টাকা দেন। তখন থেকে আমরা স্বামী স্ত্রীর মতই বসবাস শুরু করি। বাড়ি থেকে এসে সে আমাকে হোস্টেলে রেখে কাজ আছে বলে চলে যায়। এরপর সে বিভিন্ন অজুহাতে আমার সঙ্গে আর দেখা করে না। এরপর সে আমাকে বলে তার এক কোটি টাকা লোনের জন্য আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। এজন্য সে আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চায়। সেই টাকা আমার বাবার কাছ থেকে এনে দেওয়ার কথা বলে। ১৪ নভেম্বর রাত ৯টায় সে আমাকে হোস্টেলের সামনে থেকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে যায়। তার বিভিন্ন আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি সে একটা প্রতারক। আরও অনেক নারীর সঙ্গে সে এরকম প্রতারণা করেছে।