ঘুষের জন্য ছেলের চাকুরী না হওয়ায় আরেক মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় সালাম নিতে অস্বীকৃতি

Slider জাতীয় টপ নিউজ রংপুর


পঞ্চগড়: গত ৩১ অক্টোবর পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর কাটালী মীরপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সলিমউদ্দিন স্থানীয় দাড়খোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরী পদে তার ছেলের চাকরি না হওয়ায় ক্ষোভে মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান না দিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে পত্র প্রেরণ করেন।

খবর নিয়ে জানা যায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা না মানায় তিনি আদালতে মামলাও করেছেন। নিয়োগ কমিটির চাহিদা মতো আট লাখ টাকা দিতে না পারায় তার ছেলের চাকরি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

জানা যায়, আটোয়ারী উপজেলায় ২০১৫ সালে ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরী কাম দপ্তরি পথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কিছু জটিলতায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৮ সালে পুনরায় নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। নিয়োগ কমিটিতে সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা, সদস্য সচিব আব্দুল লতিফ, সাবেক সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান, উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি খলিলুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এই ছয় জন দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৮ সালের ২৫ ও ২৬ মে ওই ১৭টি বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী কাম দপ্তরি পদে আবেদনকারী প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেয় ওই কমিটি। ওই পথে দারখোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করে ৭ জন প্রার্থী। পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ জন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে তিনজনের নির্বাচিত প্যানেল তালিকা প্রকাশ করে নিয়োগ কমিটি এবং ১ জুন ১৭ জনকে নির্বাচিত করে ফলাফল প্রকাশ করে। দারখোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই পদে নির্বাচিত প্যানেলে সাদেকুল ইসলাম, আব্দুর রহিম ও সাহিবুল ইসলামের নাম রয়েছে। নিয়োগ কমিটির দাবি সবচেয়ে ভালো নম্বর পাওয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয় সাদেকুলকে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বিদ্যালয় পরিধির বাসিন্দা হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সলিমউদ্দিনের ছেলে সাহিবুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তারা এই নিয়োগে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তোলেন।

সাহিবুল ইসলাম ফলাফল প্রকাশের পরেই ৪ জুন বিজ্ঞ আটোয়ারী সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। ওই দিনই আদালতে ওই নিয়োগে অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে সাহিবুল। আদালত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ নিয়োগ কমিটির কাছে জবাব চেয়ে শোকজ করেন। কিন্তু ওই কমিটি শোকজের জবাব না দিয়ে ৫ জুন সাদেকুলকে ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করায়। নির্ধারিত সময়ে আদালতে শোকজের জবাব না দেওয়ায় আদালত ১৫ অক্টোবর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিতাদেশ দেন। পরে নিয়োগ কমিটি মিস কেস করে জেলা জজ আদালতে আপিল করলে আদালত আগামী ৬ নভেম্বর শুনানিন দিন নির্ধারণ করেন।

এদিকে আদালত ওই বিদ্যালয়ের নিয়োগ স্থগিত করলেও নৈশ প্রহরী কাম দপ্তরি পদে নিয়োগ পাওয়া সাদেকুল ইসলাম দিব্যি অফিস করছেন। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হয়েও টাকার জন্য কেবল নিয়োগ না পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাশাপাশি হতাশ স্থানীয়রাও।

এই নিয়োগে টাকা দিতে না পারায় ছেলে সাহিবুলের চাকরি হয়নি বলে দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা সলিমউদ্দিন। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এমপির প্রতিনিধি তাদের লোকজন দিয়ে আমার ছেলের চাকরির জন্য ৮ লাখ টাকা দাবি করে। আমি দরিদ্র মানুষ টাকা দিতে পারিনি বলে সাদেকুলের কাছে ১০ লাখ টাকা নিয়ে তাকে নিয়োগ দিয়েছে। কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা কোটা মানা হয়নি। ১৭টি স্কুলে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হিসেবে আমার ছেলেই কেবল আবেদন করেছিল। কিন্তু তাকেও নেওয়া হয়নি। সামান্য নৈশ প্রহরীর পদেও যদি টাকা দিয়ে নিয়োগ নিতে হয় এ জন্য তো দেশ স্বাধীন করিনি। যারা এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিচার না হলে তাদের দ্বারা আমি রাষ্ট্রীয় সম্মান চাই না।

ওই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে সাহিবুল ইসলাম বলেন, মানুষের কাছে হাসির পাত্র হয়ে গেছি। আমার আনসার ভিডিপির সনদ আছে। আমি মৌখিক পরীক্ষায় সবগুলোর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হলেও আমার চাকরি হয়নি। আমি কত নম্বর পেয়েছি তাও প্রকাশ করা হয়নি। তারা সংঘবদ্ধভাবেই টাকার বিনিময়ে সাদেকুলকে নিয়োগ দিয়েছে।

প্রতিবেশী কসির উদ্দিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হয়েও সাহিবুলের চাকরি না হওয়ায় আমরা খুব কষ্ট পেয়েছি। নিশ্চয়ই এখানে অনিয়ম হয়েছে। আমরা এই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যারা অনিয়মের সাথে যুক্ত তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

চাকরি পাওয়া নৈশ প্রহরী কাম দপ্তরি সাদেকুল ইসলাম বলেন, আমি আদালতের কোনো নির্দেশনা পাইনি তাই স্কুলে দায়িত্ব পালন করছি।

দারখোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, আমি যোগদানের কাগজ পেয়েছি যোগদান করিয়ে নিয়েছি। পরে তারা আদালতে মামলা করেন। মামলায় যা হবে আমরা তাই মেনে নিবো।

আটোয়ারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, নিয়োগ কমিটির ৬ জনের হাতে ২০ নম্বর করে ছিলো। প্রত্যেক প্রার্থীকে মোট ১২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখানে যে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা কোনো অনিয়ম হয়নি। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

একইভাবে ওই নিয়োগে টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন সাবেক সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান।

আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, আমি নিয়োগের সময় ছিলাম না। তবে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে স্বতন্ত্রভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাই সেখানে কোনো কোটা মানার সুযোগ নেই। এ ছাড়া আমাদের নিয়োগ নির্দেশনাতেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ দিতে হবে এমন কোনো নির্দেশনা ছিলো না। ওই মুক্তিযোদ্ধা আদালতে মামলা করেছেন মামলা চলমান আছে। তাই আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *