নৌদুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়

জাতীয়

noudrgoনৌদুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অধিকাংশ কমিটি হয়ে পড়েছে নিস্ক্রিয় । দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যে কয়েকটি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সেই প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কোনো কোনো দুর্ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীকে রক্ষায় ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যান। ফলে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌ দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।

সম্প্রতি বহুল আলোচিত সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাংকার (তেলবাহী জাহাজ) ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ও পদ্মার মাওয়ায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল পিনাক-৬ সহ গত পাঁচ মাসে ঘটে যাওয়া ১২টি নৌ দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এসব দুর্ঘটনার প্রতিটিতেই নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহণ অধিদফতর (ডস) মোট ১৫টি কমিটি গঠন করলেও আটটি কমিটি এখনো তদন্ত প্রতিবেদনই জমা দেয়নি। আর তদন্তের শেষ পর্যায়ে এসে বিলুপ্ত করা হয় একটি কমিটি।

গত ৯ ডিসেম্বর বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগামারি এলাকায় মংলা বন্দরের অদূরে শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ‘এমটি টোটাল’এর ধাক্কায় নিমজ্জিত হয় সাড়ে তিন লক্ষাধিক লিটার ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’। ওই দিনই ডস মহাপরিচালক অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ এর ৪৫ ধারা মোতাবেক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সংস্থার নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদকে আহ্বায়ক, পরিদর্শক মো. আবু জাফর মিয়াকে সদস্যসচিব এবং বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ নিরাপত্তা) ও নির্বাহী হাকিম গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসানকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। গত ২৫ ডিসেম্বর ১৩ কার্যদিবস পেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া ২৭ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত এই কমিটির আহ্বায়ক ও একমাত্র কারিগরি বিশেষজ্ঞ গিয়াসউদ্দিন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি।

একই ঘটনা তদন্ত করছে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নুর-উর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত আরেকটি কমিটি। কমিটির সদস্যরা গত ১২-১৩ ডিসেম্বর নিমজ্জিত জাহাজ পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া পরবর্তী সময় তারা এই দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আটক হওয়া অপর নৌযান এমটি টোটাল পরিদর্শন করেছেন। তবে তারা এখনো প্রতিবেদন দেননি।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ডসের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে এম জসিমউদ্দীন সরকার জানান, দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে ‘এমটি টোটাল’-এর চালকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতের আদেশে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। চারজন কারাবন্দি থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। এ কারণে প্রতিবেদন জমা দিতে বিলম্ব হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, সুন্দরবনে এই দুর্ঘটনার পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং সুন্দরবন বিভাগ আরো দুইটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে সে দুইটি কমিটি ইতিমধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

গত ২৫ নভেম্বর রাতে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি বিউটি অব ইমার ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে একজন নিহত হন। এর একদিন আগে ১৪ নভেম্বর ভোররাতে মংলা বন্দরের কাছে সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদ ও শ্যালা নদীর সংযোগস্থল তামবুল বুনিয়ায় তলা ফেটে ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শাহীদূত।

এ দুইটি ঘটনা তদন্তে ২৬ ও ২৫ নভেম্বর চার সদস্যবিশিষ্ট আলাদা দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুইটি কমিটিরই আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব করা হয়েছে যথাক্রমে ডসের ‘প্রকৌশলী, জাহাজ জরিপকারক ও পরীক্ষক’ড. এ এস এম নাজমুল হক ও মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমানকে। এ ছাড়া ডসের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ এবং বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ নিরাপত্তা) ও নির্বাহী হাকিম গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসানকে দুইটি কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত ১৫ কার্যদিবস অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও দুইটি দুর্ঘটনার একটিরও প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।

কমিটির প্রধান ড. নাজমুল হক জানান, ১৫ কার্যদিবস পার হওয়ার আগেই দুইটি কমিটির পক্ষ থেকে সময়সীমা সাত কার্যদিবস বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে দুইটি প্রতিবেদনই জমা দেওয়া হবে।

গত ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহি:নোঙ্গরে মালবাহী নৌযান এমভি নাফিজ তলা ফেটে কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনা তদন্তে নাবিক ও প্রবাসী কল্যাণ পরিদফতরের সহকারী পরিচালক জসীমউদ্দিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক ও ডসের পরিদর্শক এয়াছিনুল আজমকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। গত ২ ডিসেম্বর গঠিত এ কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তারা এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

গত ৬ নভেম্বর রাতে খুলনার লবনচরা এলাকায় ভৈরব নদে ডুবে যায় ক্লিংকার বোঝাই জাহাজ এমভি সাফিনা-এ-মক্কা। এই দুর্ঘটনা তদন্তে ডস মহাপরিচালক গত ১২ নভেম্বর সংস্থার নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও এখনো প্রতিবেদন দেয়নি তারা।

গত ১২ অক্টোবর রাতে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জে মেঘনা নদীতে প্রথম দফায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি টিপু-৭ ও দ্বিতীয় দফায় তেলবাহী জাহাজ এমটি নুরজাহানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নিমজ্জিত হয় সার বোঝাই নৌযান এমভি এম. সি. এল. সিন্ধু। ওই দুর্ঘটনা তদন্তে ডসের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদকে আহ্বায়ক, পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমানকে সদস্যসচিব এবং বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ নিরপত্তা) ও নির্বাহী হাকিম মোহাম্মদ সাইফুল হাসানকে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ১২ নভেম্বর গঠিত এই কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় বেধে দেওয়া হলেও এখনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নদে ডুবে যায় ক্লিংকার বোঝাই জাহাজ এমভি হাজেরা-১। এ ঘটনায় ডস মহাপরিচালক ১৪ সেপ্টেম্বর সংস্থার প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্তের জন্য বেধে দেওয়া ১৫ কার্যদিবস অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি।

গত ২৬ আগস্ট সকালে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে তেলবাহী নৌযান এমটি হেকমতের সঙ্গে সংঘর্ষে মালবাহী জাহাজ এমভি চিতলমারী ডুবে যায়। এ ঘটনায় ২৭ আগস্ট ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

৩ আগস্ট রাতে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার শিকারপুরে বিআইডব্লিউটিএর টার্মিনাল ঘাটে দুইটি যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি রাজদূত-৭ ও এমভি আঁচল-৪ এর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ২৪ আগস্ট ডসের বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ নিরাপত্তা) ও নির্বাহী হাকিম মোহাম্মদ সাইফুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা নদীতে নিমজ্জিত হয় আড়াই শতাধিক যাত্রীবোঝাই লঞ্চ এমএল পিনাক-৬। বহুল আলোচিত এ দুর্ঘটনা তদন্তে সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আইএসও-১৯৭৬ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সংস্থার ‘প্রকৌশলী, জাহাজ জরিপকারক ও পরীক্ষক’ ড. এ এস এম নাজমুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। তবে তদন্তের শেষ পর্যায়ে এই কমিটি বিলুপ্ত করেন মহাপরিচালক।

একই ঘটনায় নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নুর-উর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি ৪০ দিন পর তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি সরকার। এ ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য দায়ী একাধিক কর্মকর্তাকে আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে। ওই কমিটিকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ও তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান এবং পুন:তদন্তের দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, পরিবেশবিদ এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতারা।

এ ছাড়া জনস্বার্থে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে এবং সিটিজেনস রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব তুসার রেহমানের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেছেন। রুলে ‘পিনাক-৬ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শনাক্তকরণ ও ভবিষ্যতে নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে অভিজ্ঞ নৌ স্থপতি, নৌ প্রকৌশলী, মাস্টার মেরিনার, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, নৌ পরিবহণবিষয়ক গবেষক, নৌযান মালিক ও যাত্রী প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠনের কেনো নির্দেশনা প্রদান করা হবে না’ তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

গত ১৫ মে বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪। এই দুর্ঘটনার পর নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক’ সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তা অনেকটা অস্পষ্ট। সেখানে দুর্ঘটনার কারণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

গত ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শাথীল-১। ওই দুর্ঘটনা তদন্তে ডসের পরীক্ষক ড. এ এস এম নাজমুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। তবে কমিটির প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দায়ীদের শনাক্তরণের তথ্য-উপাত্ত পরস্পরবিরোধী। এ ছাড়া পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ওই ঘটনার পৃথক তদন্ত করেন গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তার প্রতিবেদনে নৌযানটিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করা হলেও নাজমুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রতিবেদনে ত্রুটিপূর্ণ নৌযানটিকে ফিটনেস প্রদানকারী কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়নি। ফলে ওই প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *