ঢাকা:যেসব দেশে মাজার বেশি
সাইয়্যেদাহ জয়নাব বিনতে আলী (রা.)-এর মৃত্যু হয়েছে মদিনা শরিফে, দাফন করা হয়েছে জান্নাতুল বাকিতে। অথচ তাঁর একটি কবর দামেস্কে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে তারা, যার কোনো ভিত্তি নেই। ‘কায়রো’ শহরেও তাঁর একটি প্রসিদ্ধ মাজার আছে। কিন্তু ইতিহাসগ্রন্থের কোথাও উল্লেখ নেই যে সাইয়্যেদাহ জয়নাব বিনতে আলী (রা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনো মিসর সফর করেছেন
মিসরে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম মনীষীদের মাজার আনুমানিক ছয় হাজারের বেশি। পুরো বছরের এমন কোনো দিন নেই, যেদিন কোনো না কোনো মাজারের সম্মুখে মেলা বা ওরসের আয়োজন করা হয় না। যে এলাকায় মাজারের অস্তিত্ব নেই, সেই এলাকাকে বরকতহীন মনে করা হয়। কিছু মাজার বেশ প্রসিদ্ধ, সেগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড়ও থাকে প্রচুর।
মিসরের ‘কায়রো’ শহরে হুসাইন (রা.)-এর মাজার, সায়্যিদাহ জয়নাব (রা.)-এর মাজার, সায়্যিদাহ আয়েশা (রা.)-এর মাজার, সায়্যিদাহ সুকাইনা (রা.)-এর মাজার, সায়্যিদাহ নাফিসা (রা.)-এর মাজার এবং ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর মাজার বড় মাজার হিসেবে প্রসিদ্ধ।
এ ছাড়া ‘তানতা’ নামক স্থানে শায়খ বদভি (রহ.)-এর মাজার, ‘উসুক’ নামক শহরে শায়খ উসুকি (র.)-এর মাজার এবং ‘হুমায়শা’ নামক গ্রামে শায়খ শাজেলি (রহ.)-এর মাজারও বড় মাজারের অন্তর্ভুক্ত। দূর ও কাছ থেকে মুশরিকরা এসে হুসাইন (রা.)-এর অনুমাননির্ভর এক মাজারের জিয়ারত করে। সেটার তওয়াফ করে। এবং সেখানে চতুষ্পদ প্রাণী জবেহ করে। অসুস্থদের জন্য সুস্থতার দোয়া করে। বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করে।
তুর্কির ‘কুনিয়া’ নামক শহরে অবস্থিত জালালুদ্দিন রুমি (রহ.)-এর মাজারের ওপর শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে—‘শায়খ জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) ত্রিত্বধর্ম : ইসলাম, ইহুদ ও খ্রিস্ট সমষ্টির অভিভাবক।’
‘সাম’ রাজ্যের অবস্থাও মিসর রাজ্যের মতোই। নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে যে শুধু দামেস্ক শহরেই ১৯৪টি মাজার রয়েছে। ৪৪টি মাজারের প্রসিদ্ধি আছে বিশ্বব্যাপী। ২৭টি কবর এমন আছে, যেগুলোকে সাহাবায়ে কেরামের কবর বলা হয়, অথচ এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। দামেস্ক শহরে রয়েছে ইয়াহইয়াহ ইবনে জাকারিয়া (আ.)-এর মস্তক মোবারকের মাজার। যেটি উমভি নামক মসজিদের আঙিনায় অবস্থিত। ওই মসজিদেরই আরেক কোণে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ও ইমাদুদ্দিন জঙ্গি (রহ.) ও অন্যান্য আরো অনেক বুজুর্গের কবর রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে মুশরিকরা সেসব কবরের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হয়। এবং নিজেদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণের দোয়া করে।
‘সাম’ দেশে ইবনে আরাবি ‘কুসুসুল হিকাম’ নামীয় গ্রন্থকারের মাজার রয়েছে। অথচ তাঁর ব্যাপারে আলেমদের ভিন্নমত রয়েছে। তুর্কিস্থানে ৪৮১টি জামে মসজিদ আছে, যেগুলোর প্রতিটিতে মাজার রয়েছে। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মসজিদ ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থিত। যেটা আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর কবরের ওপর নির্মিত বলে কবরপূজারিরা বলে।
ভারতে ১৫০টিরও বেশি প্রসিদ্ধ মাজার রয়েছে। যেখানে লাখ লাখ মুশরিক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়।
ইরাকের শুধু বাগদাদেই প্রায় দেড় শতাধিক জামে মসজিদ আছে, যেগুলোর প্রতিটিতেই কারো না কারো মাজার রয়েছে।
পাকিস্তানে বাহাউদ্দিন জাকারিয়া সুলতানির কবর এখন মাজার হয়ে গেছে। সেখানে কিছু লোক বিভিন্ন ইবাদত করে। সিজদাবনত হয়। প্রসাদ বিতরণ করে।
পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ শহর ‘লাহোরে’ আলী হুজুবেরির মাজার রয়েছে। যেটি বড় মাজারগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
মজার ব্যাপার হলো যে কবরগুলোকে অনেকে বরকতময় মনে করে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো ভিত্তি নেই; বরং এসব সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর গড়ে উঠেছে।
হুসাইন (রা.)-এর একটি কবর ‘কায়রো’ শহরে নির্মিত আছে। আবার আরেকটি মাজার ফিলিস্তিনের ‘আসকালান’ শহরে আছে। ‘হালব’ নামীয় স্থানের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে ‘জোশন’ নামের পর্বত কোণেও হুসাইন (রা.)-এর মস্তক মোবারকের একটি মাজার রয়েছে। এ ছাড়া আরো চারটি স্থান রয়েছে, যেখানে হুসাইন (রা.)-এর মস্তক মোবারক দাফন করার জনশ্রুতি রয়েছে। সেই চারটি স্থান এই—
১. দামেস্ক।
২. নাজাফ।
৩. কুফার মাঝখানে ‘হানানা’।
৪. মদিনা শরিফে ফাতেমা (রা.)-এর কবরসংলগ্ন।
বলা হয়, নাজাফে আলী (রা.)-এর কবরের পাশে সেই মস্তক দাফন করা হয়েছে। এমনিভাবে কারবালার ময়দানের ব্যাপারেও দাবি করা হয়, হুসাইন (রা.)-এর মস্তক মোবারক তাঁর শরীরসহ সেখানে দাফন করা হয়েছে।
সাইয়্যেদাহ জয়নাব বিনতে আলী (রা.)-এর মৃত্যু হয়েছে মদিনা শরিফে, দাফন করা হয়েছে জান্নাতুল বাকিতে। অথচ শিয়ারা তাঁর একটি কবর দামেস্কে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। ‘কায়রো’ শহরেও তাঁর একটি প্রসিদ্ধ মাজার আছে। কিন্তু ইতিহাস গ্রন্থের কোথাও উল্লেখ নেই যে সাইয়্যেদাহ জয়নাব বিনতে আলী (রা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনো মিসর সফর করেছেন।
ইসকান্দারিয়্যাহ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হলো, আবু দারদা (রা.)-কে তাঁদের আবাসস্থলের কোনো এক মাজারে দাফন করা হয়েছে। অথচ ইতিহাসবেত্তারা বলেন, আবু দারদা (রা.)-এর লাশ ইসকান্দারিয়্যায় দাফন করা হয়নি।
‘কায়রো’তে সাইয়্যেদাহ রুকাইয়্যাহ বিনতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতীকী কবর নির্মাণ করা হয়েছে। ‘নাজাফ’ শহরে নির্মিত আলী (রা.)-এর মাজারও একটি প্রসিদ্ধ মাজারেরই অন্তর্ভুক্ত। অথচ এটি প্রতীকী মাজার হিসেবে নির্মিত। মূলত আলী (রা.)-এর সমাধি কুফা নগরীর ছোট এক বস্তিতে অবস্থিত। ‘বসরা’ শহরে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর মাজার বানানো হয়েছে। অথচ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন মদিনা শরিফে এবং তাঁকে দাফন করা হয়েছে জান্নাতুল বাকিতে। ‘হালব’ শহরে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর মাজার রয়েছে; অথচ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন মদিনা শরিফে এবং তাঁকে দাফন করা হয়েছে জান্নাতুল বাকিতে।
‘সাম’ দেশের লোকেরা উম্মে কুলসুম ও রুকাইয়্যাহ (রা.) [উভয়জন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যা এবং হজরত উসমান গণি (রা.)-এর পত্নী]-এর নামে কবর তৈরি করেছে। অথচ উভয়ের মৃত্যু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় মদিনা শরিফে হয়েছে। আর দাফন করা হয়েছে জান্নাতুল বাকিতে। দামেস্ক শহরের জামে মসজিদে হুদ (আ.)-এর প্রতীকী কবর নির্মাণ করা হয়েছে; অথচ হুদ (আ.) কখনো সাম দেশে সফরই করেননি। ইয়েমেনেও একটি মাজার আছে, যেটাকে হুদ (আ.)-এর মাজার বলা হয়। ইয়েমেনের আরেক জায়গায় সালেহ (আ.)-এর প্রতীকী মাজার রয়েছে। অথচ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন হিজাজে। সালেহ (আ.)-এর আরেকটি মাজার ফিলিস্তিনে রয়েছে। আইয়ুব (আ.)-এরও একটি মাজার ফিলিস্তিনে রয়েছে। মূলত, উল্লিখিত মাজারগুলোর একটিরও কোনো সত্যতা নেই!