অনিক সরকারের জবানবন্দি মাথা ঠিক ছিল না টানা এক ঘণ্টা পিটিয়েছি

Slider রাজনীতি শিক্ষা

ঢাকা:অনিক সরকার

’ওকে আগে থেকেই শিবির বলে সন্দেহ করা হতো। যখন ওর কক্ষ থেকে ধরে আনা হয় তখন সে আবোল-তাবোল কথা বলছিল। ওর মোবাইলে ইসলামী গান ও গজল পাওয়া যায়। যখন ও শিবিরে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে এলোমেলো কথা বলছিল, তখন মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর শুরু করি। দুই দফায় মেরেছি। একবার টানা এক ঘণ্টা পিটিয়েছি।’ তবে এখনও এ ঘটনায় অনুতপ্ত নয় অনিক।

আবরার হত্যা মামলায় আদালতে জবানবন্দি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই রোমহর্ষক তথ্য দেয় অনিক সরকার। গতকাল শনিবার মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তার খাস কামরায় আসামির জবানবন্দি নেন। অনিক বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক। আবরার হত্যার পর তাকে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সে। জবানবন্দি নেওয়ার পর অনিককে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, আবরারের ওপর যারা সরাসরি হামলায় অংশ নেয় তার মধ্যে অনিক ছিল সবচেয়ে পাষণ্ড। তদন্তে উঠে আসে, হামলার সময় সে মদ্যপও ছিল। আবরারকে মারধরের সময় অশ্নীল ভাষায় তাকে গালমন্দও করে সে।

এ নিয়ে আবরার হত্যা মামলায় মোট তিনজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিল। এর আগে গত শুক্রবার জবানবন্দি দিয়েছে মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন। সে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত ক্রীড়া সম্পাদক। এছাড়া গত বৃহস্পতিবার জবানবন্দি দিয়েছে আরেক আসামি ইফতি মোশাররফ সকাল।

আবরার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ১৬৪ ধারায় অনিকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের আবেদন করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আবেদনে উল্লেখ করেন, মামলার আসামি সকাল ও জিয়ন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অনিক সরকারের নাম প্রকাশ করে। রিমান্ডে অনিক স্বীকার করে যে, সে ঘটনার সময় দুই দফায় স্টাম্প দিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক আঘাত করে।

এদিকে আবরার হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি মোয়াজ আবু হুরাইরাকে গতকাল গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর ডিবি। এ নিয়ে এ ঘটনায় ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হলো। এর মধ্যে ১৫ জন এজাহারভুক্ত আসামি।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আবরার হত্যায় গ্রেফতার অধিকাংশ আসামি জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের ঘৃণ্য অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলেও অনিক ব্যতিক্রম। সে তার ‘ভুল’ শোধরানোর জন্য একবারের জন্য সুযোগ চেয়েছে। তবে আবরারের ওপর নির্যাতনের ভয়ঙ্কর বর্ণনা তার মুখ থেকে উঠে এসেছে। অনিক জানায়, আবরার অচেতন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে বেদম মারধর করা হয়। একাধিকবার বমিও করেছিল সে। অনিক ছাড়াও আবরারের ওপর হামলায় মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মুজাহিদুর রহমানসহ অন্তত পাঁচজন জড়িত ছিল। মুজাহিদ, সকাল ও রবিনও আবরারকে দফায় দফায় মেরেছে। মারধরের এক পর্যায়ে অনিক ফোন করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেল ও মুন্নাকে। অনিক তাদের জানায়, ‘আবরারের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কোনো নড়াচড়া করছে না।’ তখন রাসেল ও মুন্না অনিককে বলে, ‘ও ঢং ধরেছে।’

সূত্র জানায়, আবরারকে তার রুম থেকে ধরে আনার পর শিবির সম্পর্কে তথ্য জানতে স্টাম্প দিয়ে মারধর শুরু করে সকাল। এ সময় একটি স্টাম্প ভেঙে যায়। পরে আরেকটি স্টাম্প দিয়ে অনিক আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকে। এক দফা মারধরের পর অনিক ২০১১ নম্বর রুম থেকে চলে যায়। তখন আবরারকে স্কিপিং রোপ দিয়ে মারধর করে মুজাহিদুল ইসলাম। রাত ১১টার দিকে আবার অনিক ২০১১ নম্বর কক্ষে আসে। তখন এলোপাতাড়ি আবরারকে পেটাতে থাকে অনিক। এসময় তাকে দেড় শতাধিক বার মারে সে। অনিকের মারধর দেখে সেখানে উপস্থিত অন্যরা আঁতকে ওঠে। ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত নির্যাতন চালিয়ে অনিক আবার কক্ষ ত্যাগ করে। নির্যাতনের শিকার আবরার এরই মধ্যে একাধিকবার বমি করেন। নিস্তেজ হয়ে ফ্লোরে পড়ে যান। তার এ অবস্থা দেখে হামলাকারীদের কেউ কেউ ভয় পেয়ে যান। তারা ফোনে আবরারের শারীরিক অবস্থা অনিককে জানায়। এরপর আবরারকে নেওয়া হয় ২০০৫ নম্বর কক্ষে। এরই মধ্যে অনিক হামলাকারীদের জানায়, যেন আবরারের হাত-পায়ে মলম লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাকে গোসল করানোর কথাও বলে অনিক। কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে যায়। তারা আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও ঢং ধরেছে। ওর কিছু হয়নি। ও ঠিক আছে।’

আসামি শুধরে দিল তার নাম: আবরার হত্যা মামলায় আরেক আসামি মাজেদুর রহমান নওরোজকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আবরার হত্যাকাে র পর আসামির তালিকায় থাকা মাজেদুল ইসলামকে শুক্রবার সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয়। শনিবার আদালতে হাজির করা হলে সে জানায়, তার নামটি ভুল বলেছে পুলিশ। সে বলে, ‘আমার নাম মাজেদুর রহমান নওরোজ। পুলিশ ভুল করে মাজেদুল ইসলাম লিখেছে।’ আবরারের বাবা ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় যে মামলাটি করেন, সেখানে আসামির তালিকায় ৮ নম্বরে তার নাম রয়েছে।

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাজেদুল বলেছে, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমাকে দেখা গেছে কি-না, জানি না। আহত অবস্থায় আবরারকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার দলে আমিও ছিলাম।’ ওই সময় বুয়েট ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা হলে ছিল না বলে দাবি করে মাজেদুলের।

মোয়াজ গ্রেফতার: আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আরেক আসামি বুয়েট ছাত্র মোয়াজ আবু হুরাইরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল সকাল ১১টার দিকে ঢাকার উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মোয়াজের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের পিরপুরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *