জোর দিতে চাই ব্যাটিং অলরাউন্ডারদের দিকে

খেলা

pic-08_167986আপনার নিজেরও নিশ্চয়ই একটা বিশ্বকাপ দল আছে। বাংলাদেশের চূড়ান্ত ১৫ জনের স্কোয়াডের ছবিটা এঁকে রেখেছেন মনে মনে। নির্বাচকদের সঙ্গে কি মিলবে সেটি? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলতে বাকি আরো কয়েক দিন। এর আগে মিলিয়ে দেখুন আমাদের নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আপনার স্কোয়াড মেলে কিনা। এরপর থাকবে কালের কণ্ঠের বিবেচনার বিশ্বকাপ স্কোয়াডও। এই ধারাবাহিকের আজকের পর্ব সাজানো হয়েছে কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরীর দল দিয়ে।

শোরগোলটা শুরু হয়েছিল লঘু স্বরে। সম্প্রতি তা পৌঁছেছে উচ্চগ্রামে। বিশ্বকাপ খেলা হবে যে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে, সেখানে নাকি রাজত্ব করবেন পেস বোলাররা। কারণ ওই দুই দেশের গতিসমৃদ্ধ বাউন্সি উইকেট। সেই হিসাবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ রণপরিকল্পনাও মায়াবী ঘাতকদের বাদ দিয়ে আগুনে-বোলারদের কেন্দ্র করে সাজানো উচিত বলে সিংহভাগের রায়। আর সেটি নীতিনির্ধারক ও ক্রিকেটপ্রেমী উভয় মহলেই।

তবে বরাবর ভিন্ন পথ বেছে নেওয়া এই আমার ভাবনার আঙ্গিকটা এবারও অভিন্ন।

অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের প্রথাগত উইকেট গতিশীল-বাউন্সি, এ নিয়ে দ্বিমত করছি না। কিন্তু ইতিহাসের আয়নার ওই যে প্রতিবিম্ব, বিশ্বকাপ-বাস্তবতায় তার প্রতিফলন কি দেখা যাবে? আমার তো যথেষ্ট সন্দেহ। ক্রিকেট-বাণিজ্যের এই রমরমা যুগে, বল্গাহীন রানচাহিদার এই উত্তুঙ্গ সময়ে অমন পেসবান্ধব চৌকো ২২ গজ থাকবে না বিশ্বকাপে। আমি বরং রানপ্রসবা ফ্ল্যাট উইকেটের আশা করছি। আর অমন আয়তক্ষেত্রে বাংলাদেশের পেসাররা যতটা সুবিধা করতে পারবেন, তার চেয়ে স্পিনাররা বেশি কার্যকর হবেন বলে আমার ধারণা।

‘পেস-পেস-পেস’ ধ্বনির প্রতিধ্বনি তাই আমার বিশ্বকাপ দলে নেই। স্পেশালিস্ট তিন পেসারকে রেখেছি কেবল। আবার স্পিনার দিয়ে যে স্কোয়াড ঠাসা, তাও না। সাকিব আল হাসানকে ধরে স্পেশালিস্ট স্পিনারও তিনজন। আমি বরং জোর দিতে চেয়েছি ব্যাটিং অলরাউন্ডারদের দিকে। যাঁরা দলের ব্যাটিং গভীরতা যেমন বাড়াবেন, তেমনি বোলিংয়েও রাখতে পারবেন সহায়ক ভূমিকা।

প্রস্তাবের আগে প্রস্তাবনা একটু বড় হয়ে গেল। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আমার বিশ্বকাপ-স্কোয়াডে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও মৌলিক গঠনপ্রণালি মাথায় রাখলে প্রথম একাদশ গড়াটা বেশ সহজ। ওপেনিংয়ে তামিম ইকবাল ও এনামুল হক সবার প্রথম পছন্দ। আমারও। তিন নম্বরে মমিনুল হককে বেছে নিতেও দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। চার-পাঁচ-ছয়ে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদ উল্লাহর ত্রয়ীকে বলব দলের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। এরপর সাব্বির রহমান। অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনার ঝিলিক আমি দেখতে পাচ্ছি এই তরুণের মধ্যে। তিন পেসারের মধ্যে মাশরাফি বিন মর্তুজা ‘অটোমেটিক চয়েজ’। তাঁর সঙ্গী হিসেবে তরুণ তাসকিন আহমেদ ও অভিজ্ঞ শফিউল ইসলামে ভরসা রাখছি। আর স্পেশালিস্ট স্পিনার তাইজুল ইসলাম।

এই একাদশ নিয়ে একমত হবেন হয়তো অনেকে। তবে আশঙ্কা করছি, এর চেয়ে বেশি লোক দ্বিমত করবেন স্কোয়াডের বাকি চারজন নিয়ে। তার পরও আমার নিজস্ব ভাবনা ও পরিকল্পনার ছাপ রাখার স্বাধীনতা নিয়ে পূর্ণ করছি ১৫ জন। আর তা খানিকটা প্রথাবিরুদ্ধ পথে হেঁটেই।

আমার প্রথম ব্যাকআপ প্রয়োজন টপ অর্ডারে। ইমরুল কায়েস এখানে হয়তো অনেকের পছন্দ। আমি কিন্তু আস্থা রাখছি সৌম্য সরকারে। দারুণ এক ব্যাটসম্যান, যাঁর পেস বোলিংটা মন্দ না। তামিম-এনামুলের ওপেনিং জুটি ব্যর্থ হলে কিংবা মমিনুল জ্বলে উঠতে না পারলে ও বিকল্প হতে পারে দুই জায়গারই। শুধু তা-ই না, ব্যাটিং অর্ডারের প্রায় সবগুলো পজিশনে খেলার সামর্থ্য সৌম্যকে স্কোয়াডে রাখতে প্রলুব্ধ করেছে আমাকে।

ছয়-সাত নম্বরে মাহমুদ উল্লাহ ও সাব্বিরের বিকল্প হিসেবে বেছে নিলাম নাসির হোসেনকে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় বছরটা ওর ভালো কাটেনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহনীর জার্সিতে অবশ্য ফর্মে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বিশেষত সুপার লিগের প্রথম ম্যাচে মোহামেডানের বিপক্ষে যে ইনিংস খেলল নাসির, তাতে ওকে না নিয়ে বিশ্বকাপের বিমানে ওঠাটা বাংলাদেশের জন্য যৌক্তিক হবে না।

ব্যাকআপ পেস বোলারের কথা ভেবেছি অনেক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্পেশালিস্ট আর কোনো পেসারকে রাখলাম না। শুরুতে যে ত্রয়ীর কথা বলেছি, তারা থাকবে আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের একাদশে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অন্য চার খেলায় দুই পেসার খেলানোর পক্ষপাতী আমি। কেন? সে ব্যাখ্যা একটু পরে দিচ্ছি। আমি শুধু পেস বোলার হিসেবে চতুর্থ কাউকে না রেখে নিচ্ছি বরং মুক্তার আলীকে। ও দলে আসবে ব্যাটিং সামর্থ্য ও পেস বোলিং দক্ষতার যুগলবন্দিতে। লোয়ার-মিডল অর্ডারে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান। অন্য স্লগারদের মতো চোখ বুজে চালিয়ে দেয় না মুক্তার, বরং সোজা ব্যাটে ‘ভি’-তে খেলার সামর্থ্য আছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাইটস্ক্রিনের দুই পাশে কতবার বলকে আছড়ে ফেলতে দেখেছি ওকে! আর উইকেট-কন্ডিশন একটু সহায়ক হলে ওর পেস বোলিংও হতে পারে দলের সম্পদ।

স্পিন-বোলিংয়ে বিকল্প হিসেবে রাখছি জুবায়ের হোসেনকে। লেগ স্পিনার এমনিতেই ক্রিকেটের বিরল প্রজাতি। আমাদের দেশে তো সেটি আরো বেশি করে। কত কত বছর পর আমরা পেলাম সত্যিকার এক লেগ স্পিন শিল্পীকে! আমার বিশ্বাস জুবায়েরকে যদি আমরা বিনিয়োগ করি, পরিচর্চা করি যথাযথভাবে- তাহলে অনেক দিন জাতীয় দলকে অনেক কিছু দিতে পারবে। আর বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চের চেয়ে ভালো প্লাটফর্ম আমরা কিভাবে দিতে পারি ওকে!

শুরুতে যে ১১ জনের কথা বলেছিলাম, এদের আমি খেলাব আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও। বিশ্বকাপে এই দুটো দলকে আমাদের হারাতেই হবে। তাদের হারানোর জন্য স্পিনারদের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহারের কথা অনেকে বলছেন বটে। তার পরও আমি খেলাতে চাই তিন পেসার। সঙ্গে সাকিব-তাইজুলের স্পিন। প্রয়োজন যদি পড়ে, তাহলে মাহমুদ উল্লাহ, সাব্বির, মমিনুলের স্পিনও তো ব্যবহার করতে পারবে অধিনায়ক। পরাশক্তি বাকি চার দলের বিপক্ষে বরং আমার বাজির ঘোড়া স্পিন। কাগজ-কলমের ওই অসম লড়াইয়ে পেস দিয়ে বাংলাদেশ জিততে পারবে না। পারলে পারবে সেই স্পিনেই। যে কারণে এক পেসার কমিয়ে ওই ম্যাচগুলোয় নেব জুবায়েবকে। যেহেতু অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের হারানোর কিছু নেই, সে কারণে জুবায়েরকে খেলিয়ে জুয়া খেলার পক্ষপাতী আমি।

আমার বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ব্যাটিং লাইন খুব বেশি ব্যাখ্যার দাবি রাখে না। বোলিংটা রাখে। সেখানে দেখুন তিনজন করে স্পেশালিস্ট পেসার ও স্পিনার। সঙ্গে ব্যাকআপ স্পিনার মাহমুদ উল্লাহ, সাব্বির, নাসির ও মমিনুল। ব্যাকআপ পেসার মুক্তার ও সৌম্য। এদের প্রত্যেকের মূল শক্তি ব্যাটিং। ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ফ্ল্যাট উইকেট হবে ধারণা করে আমি ব্যাটিংয়ের দিকেই জোর দিয়েছি।

অনেক চিন্তার পর যাদের চিন্তা থেকে বাদ দিতে হলো, তাদের কথাও বলতে চাই একটু। শতভাগ ফিট আবদুর রাজ্জাক শুধু স্কোয়াডে না, আমার একাদশেই থাকত। কিন্তু কতটুকু ফিট আছে ও, ফিল্ডিংটা কেমন করবে- এই সংশয়ে ওকে রাখতে পারলাম না। আরাফাত সানিকে রাখা গেল না তাইজুলের আগে। তাইজুলের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য অনেক বেশি আর সাম্প্রতিক সাফল্যও উপেক্ষা করার মতো না। পেসার হিসেবে রুবেল হোসেন, আল-আমিন, আবুল হোসেনের কথা ভেবেছিলাম খুব। কিন্তু এই ত্রয়ীর চেয়ে আমার দৃষ্টিতে এগিয়ে তাসকিন-শফিউল। মুক্তার যেমন এগিয়ে জিয়াউর রহমানের চেয়ে।

শেষ পর্যন্ত যারাই থাকুক নির্বাচকদের চূড়ান্ত স্কোয়াডে, তারা সবাই মিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে দেবেন- এই প্রত্যাশায় রইলাম।

জালাল আহমেদ চৌধুরীর বিশ্বকাপ স্কোয়াড

তামিম ইকবাল, এনামুল হক, মমিনুল হক, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদ উল্লাহ, সাব্বির রহমান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, শফিউল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, তাইজুল ইসলাম, সৌম্য সরকার, নাসির হোসেন, মুক্তার আলী ও জুবায়ের হোসেন।

প্রথম ম্যাচের একাদশ : তামিম, এনামুল, মমিনুল, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদ, সাব্বির, মাশরাফি, শফিউল, তাসকিন ও তাইজুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *