ঢাকা: নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাই আর নাহিরে। ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসমগ্র কবিতার বই ক্ষনিকার একটি কবিতার নাম আষাঢ়। এই কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন এটি।
কবি গুরুর এই কবিতার প্রেক্ষাপট নিরেট প্রকৃতির একটি বৈষয়িকরুপ হলে কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন কে আমরা নানা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের বর্তমাট প্রেক্ষাপটে কবির এই কয়েকটি লাইন দিয়ে সাধু সাজার চেষ্টা করা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। রাস্তায় দামী গাড়ির গ্লাসের ভেতর থেকে দেখা যায়, আরেকজন মানুষ এক মুঠো ভাতের জন্য দামী গ্লাসের বাইরে থেকে ময়লা হাতে গ্লাস নষ্ট না করে নানা ভঙ্গিমায় আকুতি জানাচ্ছেন দুটো টাকার জন্য। পরিবারের বরণপোষন দিতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের দেশের ইতিহাস। লেখাপড়ার সময় পরীক্ষার জন্য এবং অসহায় মানুষ জীবন বাঁচাতে সাহায্য চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় যে দেশে, সে দেশে অবৈধ টাকা রাখার জায়গা না থাকায় সোনা ক্রয় করে রাখা হয় বিপুল পরিমানে। জার্সি বদল করে রাজনীতির মাধ্যমে সেবাদানকারী রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ সম্পদের পাহাড়সম ক্ষমতা দ্বারা আমাদের দেশে কতটুকু মঙ্গল হবে সেটা নিয়ে ভাবনার সময় চলছে। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ মাদক আর জুয়ার মাধ্যমে টাকা ওয়ালা হওয়ার যোগ্যতা দল বদলের প্রধান হাতিয়ার হলে রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত! প্রশ্ন এখন সবার সামনে। বিশ্বাবিদ্যালয়ের ছাত্র যেখানে লেখাপড়া করে পাশ করার পর চাকুরী করে বাবা মায়ের অভাব দূর করে দেশপ্রেমিক হয়ে দেশের সেবা করবে, সেখানে লেকাপড়ার সময়ই ছাত্রদের হাতে ভিসির মত বড় পদের লোকেরা তুলে দেয় কোটি কোটি টাকা। শিক্ষকেরা নিজেদের পদ পাওয়ার জন্য বা অন্যের পদ হারানোর জন্য এমনকি নিজেদের পদ পোক্ত করার জন্য ছাত্রদের উপর নিজেদের সপে দিচ্ছেন, দিচ্ছেন টাকা পয়সা এমনকি অস্ত্র শস্ত্রও। ছিঃ ছিঃ। রাতরাতি বড় লোক হওয়ার জন্য, যশ ও খ্যাতি অর্জনের জন্য নিজেদের বিতরণও করতে হয় অনেকের। ধিক্কার ও নিন্দা জানানোর ভাষা নেই কারণ এই শব্দগুলো আরো হালকা কাজে ব্যবহৃত হয় এই জন্য। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এমন কিছু অপরাধের জন্ম হচ্ছে যে গুলোর বিচার করার জন্য বৃটিশরাও আইন করে যেতে পারেনি। আর এই নতুন অপরাধগুলেরার নিন্দা জানানোর জন্য যে সকল ভাষা দরকার তাও আবিস্কার হয়নি। সব মিলিয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি ঠিকানাও অজানা।
সংবাদমাধ্যমে খবর আছে, কোন কোন রাজনৈতিক নেতার জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগের সম্পদের সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগের পর সৃষ্ট সম্পদ অতুলনীয়। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে ও পরের সম্পদ তুলনায় অসীম। এই দল থেকে ওই দলে বা অন্য দলে, মানে দল বদল করে রাতারাতি কোটপতি হওয়ার নজীর এখন পথে-ঘাটে। বাংলাদেশে একাধিক মন্ত্রী আছেন যারা বিভিন্ন দলীয় সরকারের আমলেও মন্ত্রী ছিলেন। রাজনৈতিক মত ও পথের এই অসম সমীকরণের মাঝে তারা নিয়মিতভাবেই দেশ সেবা করে যাচ্ছেন বীরদর্পে। কখনো হাতে হাতকড়া আবার কখনো বা ফুলের মালা নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন দেশ সেবার নামে দেশের ও দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা। এটাকেই এখন রাজনৈতিক দেশসেবা বলা হয় বলেই মনে হয়। তবে ব্যতিক্রমও তৈরী হচ্ছে আজকাল। দল ক্ষমতায় থাকলে মঞ্চে না থাকলে কারাগারে এই সূত্রটির বিপরীত ও ভিন্নরুপও দেখা যাচ্ছে। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কখনো মঞ্চে আবার কখনো কারাগারেও যেতে হচ্ছে। এটা ভাল লক্ষন। ভাল দিকও। এতে রাজনীতি পরিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী হয়।
আমরা দেখেছি, অনেক মানুষ আছেন যারা জীবনে কখনো কোন উপার্জন করার জন্য কাজ করেন নাই শুধুই রাজনীতি করেন। তারা কি ভাবে বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হন, তা আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছে। এই সফলতার জন্য তাদের কি ধরণের যোগ্যতার প্রয়োজন, তাও এখন পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। মদ, নারী, জুয়া, সন্ত্রাস এই সবের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে হলে কি কি যোগ্যতা লাগবে আর ওই যোগ্য হলে কোন কোন আশ্রয় লাভ করা সম্ভব, তাও এবার পরিস্কার হওয়ার পথে। আত্মরক্ষার জন্য দায়সারা কথা বলতে গেলে রাজনীতির দোহাই দিতে হবে সেটা এখন ওপেন কৌশল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে অবৈধ কাঁচা টাকা বিতরণ করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করলেই জনপ্রতিনিধি হওয়া যাবে, ভোট তেমন জরুরী নয়, এমন গণতন্ত্রই এখন বহমান।
বলা যায়, রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও মানুষকে ঠকিয়ে যদি অবৈধ পথে বড় লোক হওয়ার সুযোগ থাকে তবে নষ্ট চরিত্রবানরা রাজনীতিতে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনীতিকে উদ্ধার করার জন্য ক্যান্সারে আক্রান্ত চলমান রাজনীতিকে মেরে ফেলা উচিত। না হয় এই রাজনীতি সংক্রমিত হয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইটিকেই মেরে ফেলবে।
পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট বলছে, সার্বিক অবস্থা এখন এমন যে, কবি গুরুর আষাঢ়ের সেই কবিতার আরো কয়েকটি লাইন মনে রাখা দরকার তা হলো
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।
প্রধান সম্পাদক
গ্রামবাংলানিউজ