আক্ষেপ নিয়েই বিদায় ডিএমপি কমিশনারের

Slider জাতীয়


ঢাকা: ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া তাঁর দায়িত্ব ত্যাগ করতে যাচ্ছেন শিগগিরই। চার বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আমাদের নিরাপদ রাখার দায়িত্বে ছিলেন। গত মাসে অবসরের বয়সে উপনীত হওয়ার পর সরকার তাঁকে আরো কিছুদিন দায়িত্বে থাকার নির্দেশ দেয়। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, তাঁর এ নতুন দায়িত্বে তিনি সফল হবেন। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

ডিএমপি থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে যে দুটি বিষয়ে আসাদুজ্জামান মিয়া আক্ষেপ করেছিলেন, তার একটি হচ্ছে ঢাকার সড়কগুলোকে যানজটমুক্ত করার ব্যর্থতা। পাশাপাশি তিনি বলেছেন যে এ জন্য দায়ী শুধু ডিএমপি নয়। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষের আইন না মানার প্রবণতাও এর জন্য দায়ী। তাঁর কথায় নিঃসন্দেহে সত্যতা আছে। তবে কথা হলো, ডিএমপির যা করার কথা, সেটি তারা ঠিকমতো করেছে কি না।

গত বছর জুলাই মাসের ২৯ তারিখে বাসচাপায় দুজন ছাত্রের মৃত্যুর পর কিছুদিন স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা ঢাকার রাস্তাঘাটের দখল নিয়ে শুধু ন্যায়বিচার নয়, সামগ্রিক পরিবর্তনের দাবিতে সরব হয়েছিল। উচ্চপর্যায় থেকে কিছু আশ্বাস এবং আরো কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি এবং পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এর প্রায় আট মাস পর ১৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে আবার দুই বাসের প্রতিযোগিতায় পথচারী পারাপারের নির্দিষ্ট স্থানে প্রাণ গেল আবরার আহমেদ নামে বিইউপির এক মেধাবী শিক্ষার্থীর। ছেলে-মেয়েরা আবার রাস্তায় নেমেছিল, তবে পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো এবারের আন্দোলন তেমন দানা বাঁধেনি।

আবরারের মৃত্যুর দুই দিন পর ২১ মার্চ তারিখে, দুর্বিনীত চালকদের নিয়ন্ত্রণকল্পে অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আসাদুজ্জামান মিয়া চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন : এক. লক্কড়ঝক্কড় বাস চলতে দেবেন না। দুই. নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে বাস দাঁড়াতে পারবে না। তিন. এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত দরজা বন্ধ রাখতে হবে। চার. প্রতিযোগিতা করে বাস চালালে বা রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কালের কণ্ঠে ২৮ মার্চ ২০১৯ তারিখে আমার এক লেখায় তাঁর প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছিলাম, আর সেই সঙ্গে অনুরোধ করেছিলাম লাইসেন্সবিহীন চালকদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে। এতে সড়কে মৃত্যু হ্রাসের পাশাপাশি যানজটও খানিকটা যে কমত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি নিশ্চিত, আসাদুজ্জামান মিয়া তাঁর কথাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেছিলেন। তবে সম্ভবত তাঁর হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে তা বাস্তবায়নে সময় দেওয়ার খুব একটা সুযোগ পাননি। অথবা বাসের চালক-মালিকচক্র এতটাই শক্তিশালী যে তিনি তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। বিদায়লগ্নে বক্তব্য প্রদানকালে যানজট নিয়ে আক্ষেপ করলেও এ বিষয়টি তিনি অনুল্লিখিতই রেখেছেন।

সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রথা আছে অসমাপ্ত কাজ সম্পর্কে উত্তরসূরিকে অবহিত করে যাওয়া। পররাষ্ট্রসচিব পদে কার্যকালের শেষ দুই সপ্তাহে, গুরুত্ব আছে অথচ জরুরি নয় এমন বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি আমি আমার উত্তরসূরির জন্য রেখে দিয়েছিলাম। কাগজে দেখলাম, অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম ডিএমপি কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। আমার অনুমান, আসাদুজ্জামান মিয়াও ডিএমপি কমিশনারের বিপুল কর্মকাণ্ডের অসমাপ্ত অংশগুলোর ব্যাপারে নতুন কমিশনারকে ব্রিফ করবেন। অনুরোধ রইল, সড়কে শৃঙ্খলা বিধানে তাঁর প্রতিশ্রুত চার দফা কর্মসূচির বিষয়টিও যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। যানজটের অনেক কারণ আছে সন্দেহ নেই, তবে বাসচালকদের বেপরোয়া আচরণ এবং পরস্পরকে আটকাতে গিয়ে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া যে একটি বড় কারণ, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

নতুন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম জ্যেষ্ঠতা এবং যোগ্যতার বিচারে পুলিশ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন—এটি আমরা ধরেই নিতে পারি। তাঁর সামনে বেশ খানিকটা সময়ও থাকবে। অনুরোধ রইল, ঢাকার রাস্তায় বাসচালক ও মালিকদের নিত্য-অরাজকতার রাশ টেনে ধরতে যেন তিনি শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেন। সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি পূর্বসূরির এই অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতিও তাঁর কার্যকালের মধ্যে বাস্তবতার মুখ দেখবে, তার প্রতি এই শুভ কামনা রইল।

লেখক : সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *