ডেস্ক: হংকংয়ে গৃহকর্মীর বড় সংকট। এখানে বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহায়তা নিতে পারে তারা। গৃহকর্মীর এই সংকট সমাধানের একটি নতুন উৎস হতে পারে বাংলাদেশ। অনলাইন সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, দীর্ঘদিন এ কাজে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে গৃহকর্মী নিচ্ছে হংকং। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে পলিসিগত জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এরই মধ্যে অনেক নারী এ কাজে হংকং যাচ্ছেন।
তার মধ্যে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করা তাজমিরাও। তার মতো অনেক যুবতী বা নারী হংকংয়ে গৃহকর্মী সংকটে বাংলাদেশের সহায়তা নিতে পারেন। এমনটা আশা করছে হংকং। সেখানে বর্তমানে প্রায় তিন লাখ ৯০ হাজার গৃহকর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ফিলিপাইনের। বাকি অর্ধেক ইন্দোনেশিয়ার। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ওপর এক্ষেত্রে কতদিন নির্ভর করা যাবে তা পরিষ্কার নয়। হংকংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ইন্দোনেশিয়ার গৃহকর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা চান। সরকারি হিসাবে হংকংয়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা। তাই আগামী তিন দশকের মধ্যে সেখানে বাড়তি ২ লাখ ৪০ হাজার গৃহকর্মী প্রয়োজন হবে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, হংকংয়ের এজিন্সিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ একটি চুক্তি করার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশি গৃহকর্মী প্রথম হংকং যাওয়া শুরু করেন। আশা করা হয়েছিল, সেখানে গৃহকর্মীর যে সংকট আছে তা পূরণ করতে পারবে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপুল পরিমাণ গৃহকর্মী পাঠানোর প্রত্যাশায় তেমন সাড়া পড়েনি। হংকং ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশি মাত্র ২৭৫ জন গৃহকর্মী গিয়েছেন সেখানে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ৫৯৪। ২০১৫ সালে ৬৫০। ২০১৬ সালে ৫১৭। ২০১৭ সালে ৫০৭। ২০১৮ সালে ৫০১ এবং এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫০৭।
তবুও বাংলাদেশি গৃহকর্মী পাঠানোর চেষ্টা চলছে। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। রিক্রুটমেন্ট বিষয়ক কোম্পানি ইউনিভার্সেল ওভারসিসের ঢাকা অফিসের প্রধান নির্বাহী জিয়াউর রহমান বলেছেন, সবেমাত্র বাংলাদেশি নারীরা বিদেশে কাজে যাওয়া শুরু করেছেন। প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ক এজেন্সিগুলো হংকংয়ের বাজার নিয়ে উৎসাহিত। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে নারীদের কাজ করতে বিদেশে যাওয়ার অনুমোদন দেয়া হতো না। কারণ বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। বিদেশে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এখানে নারীদের বিষয়ে রয়েছে রক্ষণশীলতা। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেছে। হংকং হলো নিরাপদ ও সভ্য একটি স্থান। তাই মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে এটা একটি প্রতিশ্রুত গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া নারী গৃহকর্মীদের মধ্যে শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগই যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হন।
তিন বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন তাজমিরা (২৪)। তিনি বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে একটি কাজ খুঁজছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত কোনো কাজ পাচ্ছিলেন না। ফলে তিনি গার্মেন্ট কারখানাকে বেছে নিলেন। এই কারখানায় বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। তারা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পোশাক তৈরি করেন। সেখানে কাজ করে তাজমিরা মাসে বেতন পেতেন মাত্র ১০ হাজার টাকা। এ দিয়ে ৫ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। তার ওপর নির্ভরশীল ছিল ছোট দুই বোন। তারা স্কুলে পড়াশোনা করেন। তাজমিরা বলেন, বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন কাজ। আমি পছন্দ করি, তাই এ সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছি।
বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের বহু নারীর মতো তাজমিরাও জানেন না হংকং কোথায়। কিন্তু তার দুই বন্ধু তাকে বললেন, সেখানে তারা মাসে ৪৫২০ হংকং ডলার উপার্জন করছেন গৃহকর্মী হিসেবে। এই অর্থ বাংলাদেশে তাদের আয়ের প্রায় ৫ গুণ। এ কথা শুনে তাজমিরাও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, অবশ্যই আমি বেশি অর্থ উপার্জন করতে চাই। আমার পরিবারকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে চাই। তাই প্রথমবার আমি হংকং যেতে রাজি হয়ে যাই। না, এক্ষেত্রে আমার কোনো ভয় হচ্ছে না। তবে আমার পরিবারকে মিস করবো। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে একটি চারতলা বিশিষ্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষিণ নিচ্ছেন তিনি। সেখান থেকে এ কথা বলেন তাজমিরা। এখানে তিনি চাইনিজ রান্না ও ভাষা শিখছেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক নারী ও এজেন্সিগুলো বেশ সমস্যায় পড়ছেন। জিয়াউর রহমান বলেছেন, হংকংয়ে বাংলাদেশী নারীদের কাজ করার আগে তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভাষা ও রান্না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যারা যান তাদের জন্য এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ মাত্র এক মাস। ফলে তিন মাস এসব নারীর জন্য একটি দীর্ঘ সময়। এ জন্য তাদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। তাই তার এজেন্সি কয়েক বছরে মাত্র ১০০ নারী গৃহকর্মী পাঠাতে পেরেছে হংকংয়ে।
বিদেশে নারী শ্রমিকদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানোর ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যকে আকর্ষণীয় হিসেবে দেখে থাকে এজেন্সিগুলো। ওই অঞ্চলে এক একজন নারী শ্রমিককে পাঠিয়ে এজেন্সিগুলো আয় করে ৪০০ ডলার থেকে ৫০০ ডলার। অন্যদিকে হংকংয়ে এক্ষেত্রে এজেন্সির আয় ১০০ ডলার থেকে ১২০ ডলার।
বাংলাদেশে হংকংগামী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম এভারগ্রিন হাউজকিপারস ট্রেনিং সেন্টার। এখানেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তাজমিরা। এর মালিক ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং। তিনি বলেন, হংকংয়ের মানুষের কাছে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা আকর্ষণীয় নয়। কারণ, ২০১৩ সালে প্রথম দফায় যাদের পাঠানো হয়েছে তারা প্রশিক্ষিত নন। ফিলিপাইনের গৃহকর্মীরা যেভাবে ইংরেজিতে পারদর্শী, বাংলাদেশিরা ততটা নন। এমনকি বাংলাদেশি অনেক গৃহকর্মী জানেনও না যে, গৃহকর্ম বলতে কি বোঝায়। এ কাজটি তাদের কাছে একেবারে নতুন। বাংলাদেশে তার নিজের কারখানায় কাজ করেন ১৮০০০ শ্রমিক। তিনি বলেন, এসব সত্ত্বেও সামনের দিনগুলোতে হংকংয়ে বাংলাদেশি গৃহকর্মী বাড়বে। ফিলিপাইন এখন চীনে তাদের গৃহকর্মী পাঠাতে সক্ষম হবে। ফলে এক্ষেত্রে সংকট দেখা দেবে হংকংয়ে। এই ফাঁকে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হবে। তাই হংকংয়ে গৃহকর্মী পাঠানোর বাণিজ্যে তিনি ১০ লাখ হংকং ডলার বিনিয়োগ করেছেন।
এরই মধ্যে চীনে ফিলিপিনো গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে আলোচনা করেছেন ফিলিপাইন ও চীনা কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বর্তমানে বিদেশি হিসেবে হংকং ও ম্যাকাও থেকে চীনের নির্বাচিত কিছু শহরে বিদেশি গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়া অনুমোদিত।
হংকংয়ে বাংলাদেশি গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়ার দেয়ার জন্য অনুমোদিত প্রথম হংকংভিত্তিক এজেন্সি টেকনিক এমপ্লোয়মেন্ট সার্ভিস সেন্টার। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তেরেসা লিউ সুই-লান। তিনি মনে করেন গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। তার মধ্যে প্রথম দফায় যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের অনেকেই কয়েক দিনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তারা নিয়োগকারীর কাছ থেকে পালিয়ে অবৈধভাবে কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে কেউ রেস্তরাঁয় হাঁড়িপাতিল ধোয়ার কাজ করেন। হংকংয়ে গৃহকর্মীদের মাসে সর্বনিম্ন বেতন ৪৫২০ হংকং ডলার। কিন্তু এসব কাজ করে তারা অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
সুই-লান বলেন, এভাবে গৃহকর্মী পালিয়ে যাওয়ায় আমাদের ক্লায়েন্টরা আমাদের ওপর নাখোশ। এমনো দেখা গেছে, চার বছর আগে যে গৃহকর্মী লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন অকস্মাৎ তিনি আমাদের সঙ্গে একদিন যোগাযোগ করে বসলেন। তাই হংকংয়ের খুব কম সংখ্যক এজেন্সিক এখন বাংলাদেশি গৃহকর্মী নিচ্ছে।
হংকংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসুল জেনারেল মেহদি হাসান স্বীকার করেন, কিছু গৃহকর্মী হংকংয়ে অবৈধ উপায়ে কাজ করেছেন। তবে তিনি বলেন, এমনটা আর ঘটছে না। গৃহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে ২০১৫ সালে কনসুলেট একটি লেবার অফিস স্থাপন করেছে। তিনি আশা করেন, তিন বছরের মধ্যে হংকংয়ে বাংলাদেশি গৃহকর্মীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০০। এ বিষয়ে তিনি হংকংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা কেরি লাম চেয় ইউয়েত-নগর এবং ম্যাথিউ চিউং কিন-চুং-এর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তার ভাষায়, হংকংয়ে বয়সী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হলো একটি ‘ইয়াং নেশন’। তাই দক্ষ গৃহকর্মীর জন্য একটি উত্তম উৎস হতে পারে বাংলাদেশ।