কেবিন নং – চার—-সাহদাত হোসেন

Slider সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

ডেস্ক: সকাল ৬ টা।ভাবছি মা’কে একটা ফোন দেবো।গতকালও কোন কথা হয়নি।পাশে আট বছরের ছেলেটি গতকাল থেকে প্রচন্ড জ্বরের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। হঠাৎ বেশ কয়েকটা কাক খুব করুণ স্বরে চেচাচ্ছে। মা’কে ফোন দিলাম কিন্তু ধরলেন না। আমরা মায়ের ফোন যথা সময়ে না ধরায় অভ্যস্ত। পরে কোন একসময় ফোন দিয়ে বলবে, “ফোন দিয়েছিলি কেন বাপ। আমি কোরআন পড়ছিলাম।” ছেলেটার জ্বর মাপার পর খুব দ্রুত জল পট্টি দিলাম। একটুপর আবার হাসপাতালে যেতে হবে। প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার মতো। অনেক বলেকয়ে হাসপাতাল থেকে নাইটপাশ নিয়ে বাসায় এসেছি।

আমিও অসুস্থ। বিগত তিনদিন যাবত হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম হলেও আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কারণে হাসপাতালের রুচি,চরিত্র,সেবা আমার নখদর্পনে। আমরা যারা বেসরকারি চাকরিজীবী আমাদের আবার বিশেষ একধরণের ভাব আছে। তা কাউকে দেখানো বা অহংবোধের জন্যও নয়। এটা এমন এক ভাব যার রহস্য কেবলমাত্র স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ বুঝে না। মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের টাকার সিংহভাগ স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। মাসে দুই একবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, কাছের আত্মীয়স্বজনদের কিছু দিয়ে নিজেকে দান বীর (মনেমনে) ভাবা। আর মাস শেষে বৌ কিছু বলছে তো গায়ে ফোঁসকা পড়ার জো। আমি সারাদিন অফিস করে লবণ,হুইল পাউডার,ডিম এগুলো কখন আনি? তুমি বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনার পথে কিনে এনো বলেই ব্যস্ততার অজুহাতে মোবাইলটা রেখে কাজে ডুবে যাই।আসলেই তো!! আমরা তো প্রতিদিন,প্রতিটা মূহুর্তে ডুবে যাচ্ছি।নিজের কাছে, পরিবারের কাছে,সমাজের কাছে,বন্ধুবান্ধবের কাছে, আর সরকারি চাকরিজীবীদের কাছে। মাস শেষে বৌয়ের জমানো টাকায় হাত না দিলে তো আবার ভাব থাকে না।
অফিসের পাওনা ছুটি নিয়ে বাসায় আসার পর নিজেই জ্বর,শরীর ব্যথা,মাথা ব্যাথা নিয়ে তিনদিন অতিবাহিত করলাম। এক বন্ধুর পীড়াপীড়িতে ডাঃ দেখাতে হাসপাতালে অতঃপর ভর্তি। চিন্তায় পড়ে গেলাম অফিস নিয়ে। এডমিনকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম।আমার করিৎকর্মা বন্ধু যাহা সম্ভব নয় তাই করে এনেছে।এসে বলছে দোস্ত চলো,তোমার জন্য কেবিন ঠিক করেছি। এই কেবিনে অনেকবার আসতে হয়েছে অতীতে রোগী দেখতে,সেবা করতে। এখন আমি আসছি সেবা নিতে। কেবিনে ঢুকেই তো চোখ আমার কপালে। ছাদের পলেস্তরা খুলে পড়ছে, টয়লেটের দিকে তাকিয়ে আমার এইজীবনে বাথরুমের চাপ উধাও।

বন্ধু আমার এক আয়াকে নিয়ে আসছে রুম পরিস্কার করার জন্য। আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে কয় ঘন্টা যে থাকবো…। চলে যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলাম কি নাম? উত্তর এলো ছফুরা। খুব ব্যস্ততা ওর। বললো আমার নাম্বার রাখেন, দরকার হলে ফোন দিয়েন। আমার অনেক কাজ, যাই। আমি বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম উপড় থেকে চোখে যেন কিছু না পরে। একটু পর ইসিজি করতে হবে,নতুন ভবনে যেতে হবে,শরীর খুব দুর্বল। বন্ধু ধরে নিয়ে গেলো। বেলা দুইটায় আমার ইসিজি শেষ হওয়াতে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।আগামীকাল রক্ত এবং এক্সরে করাতে হবে।ছফুরার পরামর্শ, ” আপনি ভর্তি রোগি,আপনি এতো পিছনে পড়ছেন ক্যা? কাল ভোর ছয়টায় লাইনে দাঁড়াইবেন,টাকা জমা দেয়ার জন্য নয়তো আজকের মতো বারেটা বাজবো।” সফুরা আমার তো দুইটা বাজছে। ছফুরা একগাল হাসি দিয়ে বললো, ” ঐ হইলো,সকাল সকাল লাইন না ধরলে পরে কষ্ট হয়।” ময়লার বালতি হাতে নিয়ে ছফুরা চলে গেলো।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের ঐ যে ভাবের কথা বলছিলাম,দেশ সেরা হাসপাতালের মেম্বারশিপ কার্ড এখন মরিচাধরা। বৌ বাচ্চাদের একবার ডাঃ দেখাতে পারলে রিপোর্ট দেখানোর সময় আর হয়না। ঐ ভাবটুকু হজম করে কেবল পাশে থাকা মানুষটা। আজ আমারো তাই, বউ দুপুরে খাবার এনে খাইয়ে গেছে। আর বলে গেছে,” এই যে জমিদার( এই কথাটা মাঝ মাঝে উনি আমাকে বলে,আমি তখন বেলুনের মতো চুপসে যাই) শরবত আর স্যালাইন দিয়ে গেলাম,এগুলো ছাড়া কোনকিছুই খাইবা না।আমি এখানে আর খাবার আনছি না।” দুই দোস্ত দুই বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। উপর থেকে চোখে যেন কিছু না পরে। বিকেলে আমাকে দেখতে অফিসের বড় কর্মকর্তারা হাজির। আমার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে উঁনারা বিদায় নিলেন। রাতে বাসায় চলে গেলাম,ভোরে লাইনে দাঁড়াতে হবে তাই ফজরের নামাজ পড়েই হাসপাতালের দিকে দৌড়। হাসপাতালে ঢুকতে গিয়েই মনটা বিষাদে ভারাক্রান্ত। কান্নার শব্দে সবাই যেন পাথরের মূর্তি। আমি এক পা দু পা করে জরুরি বিভাগে ঢুকলাম, টেবিলে একটা কিশোরী শুয়ে আছে, আমার মেয়ের বয়সী।একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? বললো,বিষ খেয়ে মারা গেছে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। কি সুন্দর মিষ্টি চেহারা ( আমরা অনেকে ফর্সাকে সুন্দর বলি)। আমার মেয়েটাও এমন লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। ইচ্ছে করছিলো মেয়েটির দু’চোখে হাত বুলিয়ে দেই যেমনটি করে থাকি আমার মেয়েটা ঘুমালে। রুম থেকে বের হয়েই দেখি এক মহিলা ( আমার স্ত্রীর বয়সী) ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে, শুনলাম স্বামী মারা গেছে। যার যায় সে বুঝে কি হারালো। আমি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম শ্বাসকষ্টে ভোগা লোকটি পরিবারকে অকূলদরিয়ায় ভাসিয়ে চলে গেছেন।

আমার কেবিন দোতালায়। ছফুরা সিঁড়ি ঝাড়ু দিচ্ছে,আমার দিকে তাকিয়ে সে মাথাটা নীচু করে কাজ করতে লাগলো। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে আজ এতো কষ্ট লাগছে কেন? উপরে উঠতে গেলে কষ্ট তো করতেই হয়।হোক পরিবার,সমাজ,রাজনীতি বা চাকরিতে। আমার কোন জায়গা নেই। আর কতটুকু উপরে উঠা দরকার আমার।একজীবনে? স্ত্রী সন্তানদের বঞ্চিত করে। কাজ তো করতেই হবে, কথায় আছেনা ” কর্মহীন জীবন হতাশার কাফন জড়ানো জীবন্ত একটি লাশ।”

♥হেড অফিস থেকে একটা ফোন আসছিলো। আমার অসুস্থতার কথা ইনসুরেন্সের কোম্পানিকে জানানো হয়েছে বলার জন্য।ইন্সুইরেন্স কোম্পানি কত দেয় বা কি ভাবে দেয় আমি কিছু জানিনা। ইনসুরেন্স কোম্পানীর দয়ায় পথ চেয়ে আছি।

আমাকে আরো ৫/৭ দিন এখানেই পড়ে থাকতে হবে ঐ কৃষকের বৃদ্ধ গাধার মতো। পারলে ওঠে এসো,না পারলে পড়ে থাকো।

পাদটীকাঃ আমার সামান্য জ্বর। কারো প্রয়োজন না হলে খুঁজ নেয়ার দরকার নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *