সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাকার ডুবিতে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণ অব্যহত আছে।
এদিকে চিংড়ি ঘের মালিকদের দখলে থাকা মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের দুপাশের সব সরকারি রেকর্ডিয় খাল অবমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর বৃহস্পতিবার সরেজমিন পরিদর্শনে যান খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ। পরিদর্শন শেষে স্থানীয় প্রশাসনকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রভাবশালী চিংড়ি ঘের মালিকদের দখলে থাকা সরকারি সকল রেকর্ডিয় খাল অবমুক্ত এবং খালের বাঁধ স্থাপন ও পূনঃখননের নির্দেশ দেন তিনি।
মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের খনন কাজে গতি আনতে বিআইডাব্লুটিকে আরো ছয়টি ড্রেজার দিয়ে দ্রুত কাজ করার জন্য চিঠি দেবেন বলে জানান তিনি।
সে সময় বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে থাকা বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. শুকুর আলী জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড এই খনন কাজ করবে এবং জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি কাজের তদারকী করবেন।
এদিকে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এ বিষয়ে জানান, ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটি এক কোটি ঘন মিটার মাটি খনন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ গত জুন থেকে খননকাজ শুরু করেছে। গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫৬ লক্ষ ঘন মিটার মাটি খনন করা হয়েছে। এ কাজে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১৮৭ কোটি টাকা।’
অন্যদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীসহ ১৮টি খালে তেল অপসারণে নতুন পদ্ধতি হিসেবে কচুরিপানা ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বিপুল সংখ্যক লোক সুন্দরবনের নদী-খালের তেল সংগ্রহের কাজ করছেন। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত মানুষের পায়ের চাপে নদী এবং খাল পাড়ের তেল কাদার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এতে আরেক ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। যা দীর্ঘ মেয়াদী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে।’
মৃগমারী এলাকায় তেল অপসারণের কাজে যুক্ত জয়মনি ঘোলের সালেহা বেগম, গফফার এবং আল-আমিন জানান, আগের মতো তারা তেল পাচ্ছেন না। নদীর পানিতে এখন আর তেমন তেল নেই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে এখন তারা তেল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
পরিবেশবাদীরা এ বিষয়ে বলছেন, সুন্দরবনের নদী-খালে যে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল তা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিকর তেলের ধকল কাটিয়ে কতো পরে নদী-খালে প্রাণের স্পন্দন দেখা যাবে তা বলা কঠিন।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘জোয়ারের সময়ে শ্যালা নদীর শাখা-প্রশাখায় ছোট পোনা মাছের বিচরণ নেই বললেই চলে। অথচ এই দুর্ঘটনার আগে এসকল নদীতে নৌকা নিয়ে ঢুকলেই ঝাঁক বেঁধে রেণু পোনার দল ছুটে বেড়াতে দেখা গেছে।’
জোয়ার-ভাটার টানে সুন্দরবনের নদী-নালা-খালে যাতে তেল আরো ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য বাঁশ, কাঠ ও পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীতে ভাসমান উদ্ভিদ ও তীরে গাছের গোড়া, পাতা ও কাজে লেগে থাকা তেল অপসারণে তিনটি পাম্প মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌকায় মেশিন বসিয়ে নদী থেকে পানি তুলে মোটা পাইপ দিয়ে তা গাছপালার গায়ে ছিটিয়ে তেল পরিষ্কারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ট্যাংকার ডুবির পর গত সাত দিনে সুন্দরবনের শ্যালা নদী ও আশপাশের খাল থেকে সংগ্রহ করা ৬৫ হাজার ৫০০ লিটার ফার্নেস অয়েল ক্রয় করেছে পদ্মা অয়েল। গত শুক্রবার থেকে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্থানীয় এলাকাবাসী এ তেল সংগ্রহ করেন। বন বিভাগের সহায়তায় তারা এখনো সনাতন পদ্ধতিতে পানি থেকে তেল আহরণ অব্যাহত রেখেছেন। দেড় শতাধিক নৌকা নিয়ে শ্যালা নদী এবং এর আশ-পাশের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করছেন তারা।
যেসব মানুষ তেল সংগ্রহ করছেন তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৩০০ জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস বিতরণ করেছে বন বিভাগ। যারা তেল সংগ্রহ করবে, তাদেরকে এসব গ্লাভস ব্যবহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে তেল সংগ্রহকারী শ্রমিকদের করছেন তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় একটি ভ্রাম্যমান মেডিক্যাল টিম সুন্দরবনে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. মো. বাকির হোসেন জানান, চর্ম রোগ বা ঠান্ডাজনিত যে কোনো রোগ থেকে কর্মরত শ্রমিক ও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সেখানে অতিরিক্ত মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে।
এসব তদারকির জন্য সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বাগেরহাটে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল রয়েছে।
তেল সংগ্রহের কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন মংলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাহিদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে তেল সংগ্রহ করছেন এমন ২৫০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকের নামের তালিকা প্রনয়ণ করা হয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে পর্যায়ক্রমে তেল সংগ্রহকারীদের সকলকেই তালিকাভুক্ত করা হবে। এই তালিকা খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জমা দেওয়ার পর ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে ত্রাণ হিসেবে কি দেওয়া হবে এবং মোট কতজনকে বাছাই করা হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।