সোহরাব হাসান: সাবেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন ২৮ বছর ধরে তুখোড় খেলোয়াড় হিসেবে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে বিতাড়িত হলেও এখন সোজা কথায় তিনি হলেন কিং মেকার। অবশ্য কয়েক বছর ধরে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি জনগণকেও এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁর সময়ে দেশের মানুষ অনেক বেশি সুখে–শান্তিতে ছিল। ভবিষ্যতে তিনি কিং মেকার না হয়ে নিজেই কিং হবেন। জাতীয় পার্টির সর্বশেষ স্লোগান—পল্লিবন্ধু এরশাদ আরেকবার।
এরই মধ্যে খবর এল, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ফের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সিএমএইচে। দুদিন আগেও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টি থেকে কে প্রার্থী হবেন আমিই ঠিক করে দেব।’ কিন্তু নির্ধারিত দিন তাঁর পরিবর্তে দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার দলীয় নেতাদের কাছে মনোনয়নপত্র বিতরণ করছেন। আসন ভাগাভাগি নিয়ে কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা দেখা দেয়। পত্রিকার খবর ছিল দলের সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু চট্টগ্রামে তাঁর আসনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না। এরপর আওয়ামী লীগ কক্সবাজার-৩ আসনটি তাঁর জন্য ছেড়ে দিচ্ছে—এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার আওয়ামী লীগ–প্রত্যাশীর অনুসারীরা কলাগাছ নিয়ে এক অভিনব মিছিল করে। শুধু কক্সবাজার নয়, আরও অনেক আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। কোথাও কোথাও অবরোধ, জাতীয় পার্টির অফিস ভাঙচুর হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এ অবস্থায় দলীয় প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন রয়েছে। কয়েক দিন আগে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এরশাদের এই অসুস্থতা দেখে ২০১৪ সালে তাঁর সিএমএইচে ভর্তি হওয়ার কথা মনে পড়ল। সে সময় তিনি বলেছিলেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হতে পারে না। দলের নেতাদের কাছে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার জন্য চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এরপরই তিনি হঠাৎ এক রাতে বাসা থেকে সিএমএইচে স্থানান্তরিত হন। তিনিও সাংসদ নির্বাচিত হয়ে যান। কিন্তু তাঁর নির্দেশ মেনে যাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন, তাঁরা পাঁচ বছর ধরে রাস্তায়ই পড়ে আছেন। এরশাদ সাহেব মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন। তাঁর দল থেকে যাঁরা মন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের বহুবার পদত্যাগ করতে বললেও কেউ শোনেননি। এই মুহূর্তে এরশাদ আলাদা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে দলের তিন মন্ত্রীসহ অনেক নেতাই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন। তাই জাতীয় পার্টির আলাদা নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষির কৌশল হিসেবে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন কি না, সেটাও দেখার বিষয়। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে তিনি অসুস্থ হতে পারেন না। কিন্তু তাঁর পক্ষে অসুস্থতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করা অস্বাভাবিক নয়।
নির্বাচনের জন্য আগামী কয়েকটি দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এর মধ্যে দুই মহাজোট আসন ভাগাভাগির কাজ শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেক আসনে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। নেতারা বলেছেন, হতাশ হওয়ার কারণ নেই, প্রত্যাহারের তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। প্রার্থীদের অপেক্ষার তারিখ যেদিন শেষ হবে, সেদিনই ভোটারদের অপেক্ষার পালা শুরু হবে। তাঁরা ৩০ ডিসেম্বর পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন। কিন্তু ভোটটি দিতে পারবেন কি না, সেটি নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের ওপরই।
২৭ নভেম্বর যেদিন এরশাদনামা লিখছি, সেদিন শহীদ মিলন দিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে সাবেক স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনী ড. শামসুল আলম মিলনকে হত্যা করে। তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়েই নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান চূড়ান্ত রূপ নেয়। এরশাদ সেদিন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে সাংবাদিকেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করেন। স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি।
সেদিন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ যাঁর পতন ঘটিয়েছিল, সেই স্বৈরাচারই ২৮ বছর ধরে রাজনীতিতে দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর সহযোগীরাও দুই প্রধান দলে ভাগ হয়ে তাঁর শাসনের ধারাকে জিইয়ে রেখেছেন। বছর দুই আগে এই প্রথম আলোয় লিখেছিলাম, স্বৈরাচারের পতন হয়নি। তাহলে মিলন, নূর হোসেন, তাজুল, রউফুন বসুনিয়া, সেলিম-দেলোয়ারদের জীবনদান কি বৃথা যাবে? তাঁদের আত্মা কি আমাদের ক্ষমা করবে?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।