একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও উপেক্ষিত থাকছে লেভেল প্লেøয়িং ফিল্ডের বিষয়টি। রাজনৈতিক দলগুলোর জোর দাবি থাকলেও এ প্রশ্নে নির্বিকার নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল ঘোষণার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দেয় ইসি; কিন্তু ভোটের তারিখ পরিবর্তন, দলীয় মনোনয়ন উত্তোলন ও জমা দেয়ার সময় কর্মীদের মিছিল-সমাবেশসহ নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো। অন্য দিকে নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশি তল্লাশি ও গ্রেফতারসহ নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
যদিও তফসিলের দিন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়ে সিইসি বলেন, ভোটার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রার্থী, প্রার্থীর সমর্থক ও এজেন্ট যেন বিনা কারণে হয়রানির শিকার না হন বা মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন না হন তার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ থাকবে। দলমত নির্বিশেষে সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদে সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। ভোট শেষে নিজ নিজ বাসস্থানে নিরাপদে অবস্থান করতে পারবেন। নির্বাচনী প্রচারণায় সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পাবে। সবার জন্য অভিন্ন আচরণ ও সমান সুযোগ সৃষ্টির অনুকূলে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার পরও অব্যাহত রয়েছে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না বিরোধী দলের সমর্থকেরাও। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে দিনমজুর সমর্থকদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এতে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী এবং ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল শুক্রবার সকালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ৪৭২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে দলটি।
তালিকা ছাড়াও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া ‘বানোয়াট মামলা’ প্রত্যাহারসহ গ্রেফতার নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, গত রোববার ভোট গ্রহণের তারিখ এক সপ্তাহ পেছানোর অনুরোধ জানিয়ে সিইসিকে চিঠি দেন যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও জোটের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইসি ভোটের তারিখ পিছিয়ে দিলে আপত্তি করবে না দলটি। রোববার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি চলাকালে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কথা জানান। এর পরের দিন সিইসি ভোট সাত দিন পিছিয়ে দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেন।
তবে গত ৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া টেলিভিশন ভাষণে সিইসি ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। এর পর থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের তফসিল পেছানোর দাবি জানিয়ে আসছিল; কিন্তু ইসি এ বিষয়ে কোনো কর্ণপাত করেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার থেকে দলীয় প্রার্থীদের কাছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে (৩/এ) এই কার্যক্রম চলে। মনোনয়নপত্র ক্রয়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ কার্যালয় ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। সকাল থেকেই শোডাউন করতে করতে আসেন মনোনয়ন কিনতে আসা নেতাকর্মীরা।
দলে দলে মিছিল নিয়ে আসেন ধানমন্ডিমুখী মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। ব্যানার-ফেস্টুনসহ নানা বাদ্যযন্ত্র রয়েছে তাদের বহরে। ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেগ পেতে হয়।
ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের সমাগমে পুরো ধানমন্ডিতে দেখা দেয় যানজট। এর মধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনাও ঘটে। অনেকেই মিছিল সহযোগে এসে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় দলটির কার্যালয়ে। দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় দুইজন পথচারী নিহত হন। এর পরও পুলিশ অথবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশের ব্যাপারে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এবার মনোনয়ন ফরম কেনায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আমরা লক্ষ করছি। আমরা ডিসিপ্লিন রক্ষা করার চেষ্টা করি, কিন্তু আজকে ডিসিপ্লিন রাখার মতো অবস্থা নেই।
অন্য দিকে গত সোমবার থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে বিএনপি। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ উপলক্ষে নেতাকর্মীদের ব্যাপক সমাগমে সারা দিন জনসমুদ্রে ভাসতে থাকে রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকা।
সকাল থেকেই ব্যানার-ফেস্টুনসহ মিছিল নিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে থাকেন। অনেকে ব্যান্ড পার্টি, হাতি ও ঘোড়াও সাথে আনেন।
গত বুধবার সকাল থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাকর্মী-সমর্থকদের ভিড় ছিল। পুলিশ রাস্তায় তাদের দাঁড়াতে দিচ্ছিল না।
বেলা পৌনে ১টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বড় একটি মিছিল নিয়ে ঢাকা-৮ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আসেন। ওই সময় কার্যালয়ের সামনে থেকে তার মিছিল সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। তবে কর্মী-সমর্থকেরা সরে না যাওয়ায় একপর্যায়ে পুলিশের গাড়ি মিছিলের ওপর উঠে যায়। ওই সময় কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের বাগি¦তণ্ডার ঘটনা ঘটে। মুহূর্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ নেতাকর্মীদের ওপর লাঠি চার্জ করে। এ সময় পুলিশের সাথে নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পুলিশ প্যালেট বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। একপর্যায়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় তিনটি মামলায় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।