বিএনপি মনে করে খালেদার সাজার নেপথ্যে দুই কৌশল

Slider রাজনীতি

ঢাকা: পরপর দুই দিনে পৃথক মামলায় কারাবন্দী খালেদা জিয়ার আরও বড় দণ্ডের রায়কে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এই দণ্ডের নেপথ্যে সরকারের দুটি রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। এক. খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। দুই. কৌশলে দলের নেতৃত্ব থেকে খালেদা জিয়াকে সরানো।

অনেক দিন ধরেই বিএনপির নেতারা বলে আসছিলেন যে সরকার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। এ লক্ষ্যে সাজানো মামলায় তাঁদের আসামি করে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুই মামলায় খালেদা জিয়ার ১৭ বছর, আর তিন মামলায় তারেক রহমানের একটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্য দুটিতে ১৭ বছর সাজা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আদালতের রায়ের পূর্বাপর পর্যালোচনা করে বিএনপির নেতারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো এবারও বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সর্বাত্মক কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে নির্বাচনের আগমুহূর্তে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বড় সাজার রায় এসেছে।

বিশেষ করে, গতকাল মঙ্গলবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় উচ্চ আদালতের রায় বিএনপির নীতিনির্ধারকদের হতবাক করেছে। তাঁরা বলছেন, সাধারণত উচ্চ আদালতে দণ্ড কমে। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালতের দেওয়া খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড গতকাল হাইকোর্ট আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন। এই রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও বহাল থাকলে খালেদা জিয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এমনকি পরের নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। কারণ, ফৌজদারি মামলায় কেউ ন্যূনতম দুই বছরের সাজা পেলে, সাজা শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন।

এদিকে লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তিন মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। অন্য দুটি মামলায় তারেক রহমানের যথাক্রমে ৭ ও ১০ বছর সাজা হয়। আপিল বিভাগে তাঁদের সাজা স্থগিত বা রদ না হলে দুই নেতাই নির্বাচনের অযোগ্য হবেন।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাও এখানে কাজ করছে। সরকার বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায় বলেই আদালতে এমন রায় এসেছে।’

বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন মহলে নানা কথা আছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আদালতের বড় সাজার কারণে দুই নেতার দলের নেতৃত্বে থাকাটা অনিশ্চিত করে তুলেছে। খালেদা জিয়ার দীর্ঘ কারাবাস ও তারেক রহমানের অনিশ্চিত দেশে ফেরা—দীর্ঘ সময় এ দুটি বিষয় চলতে থাকলে বিএনপির নেতৃত্বে তাঁদের থাকাটা অকার্যকর করে তুলতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। কারণ, নির্বাচনী ডামাডোলে ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি অনেকটা কাগুজে বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই রায়ের পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য দুটি। একদিকে দলের মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হতাশা তৈরি করা, অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বকে উত্তেজিত করে আবারও নির্বাচন বর্জনের দিকে ঠেলে দেওয়া। সরকারের এই কৌশলের বিপরীতে বিএনপির কী কৌশল হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে দলের নীতিনির্ধারকেরা ইতিমধ্যে নেতা-কর্মীদের নির্বাচন ও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির মতো এবার ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, এই রায়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে এই রায় স্পষ্টতই ইঙ্গিত বহন করে যে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না, তারা আবারও একতরফা নির্বাচন করবে।

বিএনপির নেতারা অভিযোগ করছেন, সরকার একদিকে সংলাপের আয়োজন করছে, আরেকদিকে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর ও আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, গতকাল মঙ্গলবার সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও ময়মনসিংহে ২২ জন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ২২ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে সিলেটে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদসহ আট নেতা-কর্মী এবং হবিগঞ্জে হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সজিব আহমেদ ও অপর এক কর্মীকে আটক করা হয়েছে। মিছিল করার চেষ্টাকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুন মাহমুদসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। ময়মনসিংহে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ আমজাদ আলী ও গাইবান্ধায় জামায়াতের পাঁচ নেতাকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সহপ্রচার সম্পাদক এস এম জাহেদকে সাদাপোশাকের পুলিশ তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ তা স্বীকার করছে না।

মওদুদ আহমদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে পাঁচ হাজার গায়েবি মামলায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মী আসামি। অথচ কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আসলে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না যায়, সে ব্যবস্থাই সরকার করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *