দ্রুতগতির ফ্রান্স ফাইনালে

Slider খেলা

France-National-Football-Team-World-Cup-Squad-784x441
ফ্রান্সের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন তিনি—১৪২টি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে গোল মোটে দুটি। যেহেতু ডিফেন্ডার, সে কারণে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ওই গোল দুটির গুরুত্ব জানলে বিস্ময় জাগতে বাধ্য। লিলিয়ান থুরামের গোল দুটি যে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে! ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পিছিয়ে থাকা সে ম্যাচ জিতে ফাইনালে ওঠে ফ্রান্স। সেখানে ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে প্রথমবারের মতো।

স্যামুয়েল উমতিতির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হলো মাত্র। ফ্রান্সের জার্সিতে কাল মাঠে নেমেছেন ২৪তম বারের মতো। আগের ২৩ খেলায় দুটি গোলও করেছেন। তবু কাল এই ডিফেন্ডার যেন ফিরিয়ে আনলেন ২০ বছর আগের কিংবদন্তিকে। থুরামের মতোই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যে গোল করেছেন উমতিতি! তাতে থেমে যায় বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের স্বপ্নদৌড়। তাদের ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ঠিকই টিকিয়ে রাখে ফ্রান্স। ফাইনালে উঠে দিদিয়ের দেশমের দল এখন অপেক্ষায় ইংল্যান্ড-ক্রোয়েশিয়া দ্বিতীয় সেমিফাইনালের বিজয়ীর জন্য।

সেন্ট পিটার্সবার্গের কালকের দ্বৈরথ হতে পারত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারও। শহরে হলুদ আর আকাশি-সাদা জার্সিধারী ছিলেন অনেক; স্টেডিয়ামের ভেতরেও। নিজেদের গান গেয়ে দুঃখ ভুলতে চেয়েছে তারা। কিন্তু ম্যাচ শেষে ছড়িয়েছে কেবলই ফরাসি সৌরভ। শেষ বাঁশির পর ফ্রান্সের বাঁধভাঙা উল্লাসের বিপরীতে কান্নায় মুষড়ে পড়া চেহারা বেলজিয়ানদের।

ফ্রান্সকে ফাইনালের টিকিট এনে দেওয়া উমতিতির গোলটি যেকোনো সেন্টার ফরোয়ার্ডের জন্যও গর্বের হতে পারে। কর্নার থেকে আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান উড়িয়ে মারেন বল। একটু পেছন থেকে দৌড় শুরু করা উমতিতি প্রথম পোস্টে পৌঁছে যান সময়মতো। লাফ দেন নিখুঁত টাইমিংয়ে। তাতে পরাস্ত মারুয়ান ফেলাইনি; বাতাসে যাকে হারানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। আরো কঠিন বলের সঙ্গে মাথার অমন যথার্থ সংযোগ। উমতিতির সেই হেডে কিছুই করার ছিল না বেলজিয়াম গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার।

এরপর চেষ্টার কমতি করেনি বেলজিয়াম। কিন্তু ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচের মতো দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। পারেনি নিজেদের প্রথমার্ধের পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি করতেও। বরং গোল পেয়ে যাওয়া ফ্রান্স দারুণভাবে নিয়ে যায় মাঝমাঠের দখল। পল পগবা, ব্লেইস মাতুইদি, এনগোলো কান্তেরা খেলেছেন নিজেদের খেলা। গতি-ড্রিবলিংয়ে হ্যাজার্ডের কয়েকটি দৌড় আর দূরপাল্লার কিছু শট ছাড়া তেমন কোনো ওপেনিংই তো করতে পারেনি বেলজিয়াম।

ফ্রান্স গোল পেয়ে যায় ৫১তম মিনিটে। প্রথমার্ধ শেষ হয়ে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়েছে কেবল। তাতে প্রাধান্য বেলজিয়ামেরই। গোল পায়নি বটে, তবে অনেক অসাধারণ মুহূর্ত উপহার দিয়েছে ‘লাল শয়তান’-এর দল। রোমেলু লুকাকু নিষপ্রভ থাকলেও কেভিন ডি ব্রুইন ও এডেন হ্যাজার্ড ফরাসি রক্ষণভাগে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন বারবার। ১৬তম মিনিটে যেমন প্রথমজনের বুটের বাইরের প্রান্তের ছোট্ট স্পর্শে বল পেয়ে দ্বিতীয়জনের শট একটুর জন্য চলে যায় পোস্টের বাইরে। মিনিট তিনেক পর ফ্রান্সের রাইট ব্যাক বেঞ্জামিন পাভার্দকে গতি আর কাঁধের ঝাঁকুনিতে বোকা বানিয়ে জায়গা করে নেন হ্যাজার্ড। এরপর তাঁর ভয়ংকর গতির শট রাফায়েল ভারানের মাথায় লেগে আবার বার উঁচিয়ে যায়। আরেক জাদুকরী দৌড়ে পগবা-পাভার্দ-মাতুইদিকে পেছনে ফেলেছিলেন চেলসিতে খেলা প্লে-মেকার। কিন্তু শেষ স্পর্শটা একটু ভারী হওয়ায় বল চলে যায় গোললাইনের ওপাড়ে। আরেকবার কর্নার থেকে টোবি অল্ডারভেইল্ডের বাঁ পায়ের দারুণ শট আরো দারুণভাবে ফেরান ফ্রান্স গোলরক্ষক হুগো লরি।

ফ্রান্সের কৌশল ছিল প্রতি আক্রমণের। তাতে কয়েকবার গোলের কাছাকাছি যায় তারা। কিন্তু অলিভিয়ের জিরদের মতো স্ট্রাইকার থাকলে যা হয় আর কী! বিশ্বকাপে এখনো গোলের দেখা পাননি এই ফরোয়ার্ড; কালও পাননি। পগবার চিপ থেকে কিলিয়ান এমবাপ্পের ফ্লিকে সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন না। আরেকবার বেলজিয়ান রক্ষণভাগের ওপর দিয়ে ভাসানো গ্রিয়েজমানের রিভার্স পাসে এমবাপ্পের সাইডফুটে প্রথম টাচে বল বিপজ্জনক এলাকায় ফেললেও নির্বোধের মতো তা বাইরে মেরে দেন জিরদ। বলের সঙ্গে সংযোগটা করতেই পারেননি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের মতো না হলেও এমবাপ্পে গতির ঝড় তুলেছেন কালও। বিশেষত প্রথমার্ধের শেষদিকে তিন ডিফেন্ডার পরিবেষ্টিত হয়েও যেভাবে ছোট্ট এক পাসে পাভার্দকে গোলমুখ খুলে দিয়েছেন, সেটি মনে রাখার মতো। ওভারল্যাপিংয়ে থাকা রাইট ব্যাকের মাটি কামড়ানো শট পা দিয়ে কোনোমতে বাঁচান কোর্তোয়া।

আর প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে তো ফ্রান্সকে ডুবাতে বসেছিলেন উমতিতি। ডান দিক থেকে ডি ব্রুইনের ক্রসে বল ক্লিয়ার করতে পারেননি। ঠিক পেছনে থাকা লুকাকুরও যেন তা বিশ্বাস হয়নি। তাই তো দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি বলে বল তাঁর পায়ে লেগে চলে যায় গোললাইনের বাইরে। প্রায় খলনায়ক হওয়ার মুহূর্ত থেকে বিরতির পরের ছয় মিনিটের মধ্যেই ফ্রান্সের নায়ক বনে যান উমতিতি।

আর একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের ২০ বছর পর আরেক সেমিফাইনালে যখন আরেক ডিফেন্ডারের গোলে জিতল, ফুটবল-দেবতার ইশারা হয়তো বুঝতে পারছে। বিশ্বকাপ জিতবে তাহলে ফ্রান্সই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *