ডিজিটাল বিল: গণমাধ্যমের ওপর সরকারি বাহিনীর কর্তৃত্ব বাড়বে

Slider তথ্যপ্রযুক্তি

930a099e3587bda87959c73dfabec492-5b03c2989cd4d

ঢাকা: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গণমাধ্যমকে লক্ষ্যবস্তু (টার্গেট) করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হচ্ছে না। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে না। গত ১৯ এপ্রিল সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এসব কথা বলেন।

আইনবিদেরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলটি বর্তমান অবস্থায় জাতীয় সংসদে পাস হলে র‍্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আনসারের মতো সরকারের বাহিনী ও সংস্থাগুলো কার্যত গণমাধ্যমের চূড়ান্ত সম্পাদক (সুপার এডিটর) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। গণমাধ্যমের কোন খবর ঠিক, কোনটি ক্ষতিকর—এসব কিছু তাদের যুক্তি ও খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করবে।

আইনবিদদের মতে, আইনটি পাস হলে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থাগুলো বিটিআরসিকে যেকোনো ডিজিটাল গণমাধ্যম আটকে দেওয়ার (ব্লক) অনুরোধ করতে পারবে। উল্লেখ্য, বিটিআরসি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, এর সদস্য হতে হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা থাকা দরকার। কিন্তু এই শক্তিশালী কমিশন র‍্যাব-পুলিশ বা অন্য বাহিনীর ‘অনুরোধ’ পেলে ‘তাৎক্ষণিক’ তা পালন করবে।

২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনেও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ওই আইনে অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িত কম্পিউটার জব্দ করতে হলেও আদালতের অনুমতির কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮-এর ১ উপধারা বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি হলে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ করা যাবে।

জাতিসংঘের ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং ফাইবার অ্যাট হোম-এর চিফ টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসি চাইলে যেসব পত্রিকার স্ট্যান্ডার্ড হাইপার টেক্সট ট্রান্সফার প্রটোকল (এইচটিটিপি) আছে, তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে কোনো কিছু অপসারণ করতে না পারলেও ওয়েবপেজ আটকে দিতে পারবে। কিন্তু যাদের এইচটিটিপির ‘এস’ (সিকিউরড) যুক্ত ওয়েব লিংক থাকবে, তাদের কোনো কিছু বিটিআরসি ব্লক বা অপসারণ করতে পারবে না। এ ছাড়া যেসব পত্রিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হোস্ট করা আছে, সেগুলো শুধু বাংলাদেশের সীমার মধ্যে দেখা যাবে না, তবে বাদবাকি বিশ্ব দেখতে পারবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা বাড়বে

ডিজিটাল বিলের ৪৩ ধারামতে, কোনো অপরাধ সংঘটিত বা অপরাধ ঘটার সম্ভাবনা কিংবা আলামত নষ্ট হওয়ার বিষয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রতীয়মান হলে তিনি বিষয়টি তাঁর দপ্তরে লিপিবদ্ধ করে কোনো পত্রিকা অফিসে গিয়ে তল্লাশি, কম্পিউটার সিস্টেম জব্দ, কারও দেহ তল্লাশি ও সন্দেহভাজনকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারবেন।

ডিজিটাল বিলের ৮-এর ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করলে এবং জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব তথ্য-উপাত্ত অপসারণ করতে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এর ৩ উপধারা বলেছে, অনুরোধপ্রাপ্ত হলে বিটিআরসি উক্ত বিষয়াদি সরকারকে অবহিতক্রমে তাৎক্ষণিক উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো আটকে দেবে।

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা সরকারের উদ্বেগের দিকগুলোর যথার্থতা স্বীকার করে বলেছেন, এ রকম বিধান থাকলে বাক্স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর তার শীতল প্রতিক্রিয়া পড়বে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর মানে হলো, বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে আমরা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের যুগে ফিরে যাব।’

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা স্পষ্ট করা উচিত। কারণ, সেনাবাহিনীও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় পড়ে।

আইনে একজন মহাপরিচালকের অধীনে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি করার কথা বলা আছে। তার অধীনে গঠিত একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। তারা কীভাবে কাজ করবে, তা বিধির মাধ্যমে ঠিক হবে। সুতরাং এই বিলই শেষ কথা নয়, বিধিগুলো আরও কঠোর করার সুযোগ থাকছে।

চুয়াত্তরের আটটি অপরাধ ডিজিটাল আইনে

১৯৭৪ সালের আইনে কী কারণে সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করা হতো, সে বিষয়ে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত আইন শব্দকোষ-এ যে আটটি সংজ্ঞার তরজমা রয়েছে, তার সঙ্গে ওয়েবসাইট আটকে দেওয়ার বিধানের মিল রয়েছে। চুয়াত্তরের ওই আটটি অপরাধের আটটিই কমবেশি ডিজিটাল আইনে ফিরে এসেছে। ডিজিটাল আইনের ৮ ধারায় তিনটি [প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, জাতিগত বিদ্বেষ], ২৫ ধারায় একটি [ভীতি প্রদর্শন], ২৭ ধারায় দুটির [বিদেশি রাষ্ট্র ও জনশৃঙ্খলা] এবং ৩১ ধারায় দুটি [নিরাপত্তা ও সম্প্রদায়-সংক্রান্ত] বিধানের মিল দেখা যায়।

১৯৭৪ সালের বিধানে ক্ষতিকর কার্য বিবেচনায় পত্রিকা বন্ধ এবং বাজেয়াপ্তের বিধান করা হয়েছিল। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামান কী কী কারণে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হতো, তা আটটি দফায় গ্রন্থনা করেছেন। এগুলো থেকে দেখা যায়, যেসব কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনলাইন পত্রিকা আটকে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, তা চুয়াত্তরের বাতিল করা বিধানেও ছিল।

ওই আটটি হলো ১. বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষা; ২. বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক; ৩. দেশের নিরাপত্তা বা জননিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা বিপন্ন; ৪. বিভিন্ন সম্প্রদায় বা শ্রেণির মধ্যে ঘৃণা বা শত্রুতা তৈরিতে উসকানি; ৫. আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় হস্তক্ষেপ বা উত্তেজিত করা; ৬. অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো; ৭. সমাজে ভীতি বা সন্ত্রাস সৃষ্টি; ৮. রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বা আর্থিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা করবার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।

সম্পাদকদের রক্ষাকবচ নেই

অনলাইনে যেসব বিষয়কে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার পরিভাষা কিছু ক্ষেত্রে ২০০৬ সালের যেসব বিতর্কিত ধারা বাতিল করা হচ্ছে, তার চেয়ে খারাপ। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে যথেচ্ছভাবে আইন অপপ্রয়োগের দুয়ার খুলে দেওয়ার ঘটনায় আইনবিদদের অনেকেই বিস্মিত। এতে গ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বাড়বে বলেও তাঁদের মত।

সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা তাঁদের অনলাইন প্রকাশনার জন্য ডিজিটাল আইনে পুলিশের দয়ার ওপর কাজ করবেন। অথচ সিআরপিসির ১০৮ ধারায় ১৯৭৩ সালের মুদ্রণ ও ছাপাখানা আইনে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রকের জন্য রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছিল। এই বিধান এখনো ওই ১০৮ ধারাতেই আছে। সিআরপিসির ১০৮ ধারায় বলা আছে, ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা আইনের আওতায় নিবন্ধিত কোনো পত্রিকার সম্পাদক, মালিক, প্রকাশক এবং মুদ্রণকারীকে দণ্ডবিধির আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহ, ঘৃণা ও ভীতির সঞ্চার-সংক্রান্ত ধারায় কোনো অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এলেও সরকারি কর্তৃপক্ষ কিংবা অনুমোদিত কোনো কর্মকর্তার আদেশ ছাড়া মামলা নেওয়া যাবে না। ওই সব অপরাধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে এ ধরনের রক্ষাকবচ মুদ্রণে বজায় থাকলেও অনলাইনে থাকবে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রক্ষাকবচ তুলে দিয়ে বলা হয়েছে, অনলাইন পত্রিকার ‘আপত্তিকর তথ্য’ পুলিশ ও আনসার, বিজিবি বা র‍্যাব নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে সব ধরনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এই প্রথম ঢালাও লাইসেন্স পেতে যাচ্ছে। এতে বিটিআরসি ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে পড়বে।

চুয়াত্তরের থেকেও বিচ্যুতি

১৯৭৪ সালের আইনে ছাপা সংবাদপত্র নিষিদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত করাই শেষ কথা ছিল না, দ্রুত প্রতিকার চাওয়ার উপায় ছিল। এখন ডিজিটাল সংবাদপত্র ব্লক করার পরে সংক্ষুব্ধ পক্ষ কার কাছে প্রতিকার চাইবে, তা আইনে বলা নেই। কারণ, আদেশের বিরুদ্ধে কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল বা নালিশ করা বা দ্রুত আত্মপক্ষ সমর্থন করার বিধান নেই। কোনো ওয়েবসাইট ব্লক হলে তা কত দিন চলবে, সে বিষয়ে সময়সীমা নেই।

লক্ষণীয় যে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বা ১৯৯১ সালে বিএনপির আনা সিআরপিসির ৯৯ক ধারায় ধর্মীয় অনুভূতির দায়ে ছাপা সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করার বিধান ছিল না। বিতর্কিত ৫৭ ধারায় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত করার অপরাধে বিচার করার বিধান ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ (শুধু ব্লক করার জন্য) ক্ষুণ্ন করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে বিষয়টিকে আরও বেশি অস্পষ্ট ও বিস্তৃত করেছে। এখন পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও র‍্যাব কিসে ধর্মীয় মূল্যবোধ ক্ষুণ্ন হয়, তা ঠিক করবে এবং বিনা বিচারে অনলাইন ব্লক এবং পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করতে পারবে।

১৯৭৪ সালের আইনের ১৭ ধারায় বলা ছিল, সরকার পত্রিকার কপি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে অবহিত করবে, মুদ্রিত কপি জমা দিতে, বিতরণ বন্ধ করতে এবং কে লিখেছে, তার নাম অবহিত করতে লিখিত আদেশ দেবে, সেই আদেশে সরকারকে গ্রাউন্ডস বলতে হবে এবং সেসব আদেশের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত সম্পাদক বা সাংবাদিককে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে। আত্মপক্ষ সমর্থন করা যে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার, সেটাও সরকারকে বলতে হবে। অথচ ডিজিটাল বিলে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিধান যুক্ত করার অভিপ্রায় সরকার ব্যক্ত করেনি। অবশ্য সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

চুয়াত্তরের আইনে বলা ছিল যে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে এসআই পদের নিচে নয়, এমন পুলিশ কর্মকর্তা পরোয়ানা হাতে পত্রিকা অফিস তল্লাশি করবেন। যেকোনো তল্লাশি সূর্যাস্তের পরে ও সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ডিজিটাল আইনে এ রকম রক্ষাকবচই থাকছে না।

উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের আইনের বিলুপ্ত ১৮ ধারায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সরকারের কাছে তা জমাদানের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান ছিল। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট রিপোর্ট নিষিদ্ধ করার আদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান ছিল। এমনকি ওই আপিল জেলা জজের শুনানি সাপেক্ষে নিষ্পত্তির বিধান ছিল। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৯৭৪ সালের ওই বিলুপ্ত ধারার অপরাধগুলো হুবহু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার চাওয়ার ন্যূনতম পথ খোলা রাখা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *