মাহাথিরের বয়স ধরে রাখার রহস্য

Slider বিচিত্র

0e0645b54357c9bbc4597fcacea2b97a-5af529f99579b

ঢাকা: মাহাথিরের বিজয়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশ্বিক তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর লেখা আপনারা পড়বেন। সেই ভিড়ে আমি যাব না। আমার স্ত্রী আমাকে বলেছেন, সব সময় ভিড় এড়িয়ে চলবে। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াবে।

কাজেই আমি সেই বিষয় নিয়ে কথা বলব, যে বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলবেন না। মাহাথির মোহাম্মদের যৌবন ধরে রাখার রহস্য। কী করে তিনি জরাকে জয় করলেন। ৯৩ বছর বয়সেও তিনি কেমন করে এত তরুণ। তাঁর বয়স ধরে রাখার রহস্যটা কী?
এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকায় একটা নিবন্ধ বেরিয়েছিল গত বছর। তাঁরা মাহাথিরকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনাকে এত তরুণ দেখায় কেন?
মাহাথির যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা বলার আগে কিছু ভণিতা করে নিই।
বাংলাদেশে যদি আপনি কোনো বয়সকে হার মানানো প্রবীণকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই (বোন), আপনি এই বয়সেও এত টগবগে আছেন কীভাবে?’ তিনি জবাব দেবেন, ‘প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল আর মাছ খেয়েছি তো জীবনে!’
‘ও আচ্ছা আচ্ছা।’
‘আর জানেনই তো, শাকসবজি, ফলমূল আর মাছে থাকে ফরমালিন, যা পচন থেকে আমিষকে রক্ষা করে। ফলে আমি চিরসবুজ।’
সম্প্রতি টেলিভিশনের এক শোতে দেখলাম, একজন বিজ্ঞানী জানালেন, ফরমালিন কাজ করে শুধু আমিষে, মাছ-মাংসে; ফলে-সবজিতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, কাজেই ফলে সবজিতে ফরমালিন দেওয়া বৃথা, কেউ দেয় না, আর যদি দেয়ও, তা দেয় অজ্ঞতাবশত।
আমাদের এক আপা তাঁর বয়স লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন। ৫০ বছর ধরে আমরা দেখছি, তাঁর বয়স ২২ বছর। এই আপাকে আমরা ডাকি ফরমালিন আপা বলে।
এই বিষয়ে নাসির উদ্দিন হোজ্জার কৌতুকটা বলে রাখা ভালো। হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার বয়স কত?’
‘৮০ বছর।’
‘৫ বছর আগেও আপনি বলেছিলেন আপনার বয়স ৮০ বছর। আপনার বয়স কি বাড়ে না নাকি?’
‘আমি সত্য কথা বলা সাচ্চা মানুষ। সাচ্চা মানুষের কথা এক। কথার কোনো নড়নচড়ন নেই।’
রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে, ‘কবির বয়স’-তাতে তিনি বলেছেন,
‘কেশে আমার পাক ধরেছে বটে,
তাহার পানে নজর এত কেন?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি এক বয়সী জেনো।’

আচ্ছা, আচ্ছা। এইবার আমি আমার কথা বলি। আমাকে লোকে বলে, আপনার সব চুল পেকে গেল কী করে?
আমি বলি, আমি প্রচুর ফল খাই। পাকা ফল। ফলে ফল পাকানোর ওষুধ থাকে, কার্বাইড ইত্যাদি। সেসব খাওয়ার ফলে আমার চুল পেকে গেছে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা করে নতুন কাজের বুদ্ধি তাঁর মাথায় আসে, আর তখনই নতুন করে তারুণ্য এসে ভর করে তাঁর মধ্যে, নতুন উদ্যম, নবযৌবন ফিরে পান তিনি। একবার তাঁর মাথায় এল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ধারণা, তিনি লেগে পড়লেন বিপুল যৌবন জলতরঙ্গ নিয়ে। একবার তাঁর মাথায় এল পত্রিকা প্রকাশ করবেন, সাহিত্য পত্রিকা, কণ্ঠস্বর, সেটা নিয়ে তিনি লেগে পড়লেন। তারুণ্য এসে গেল। ৬০ বছর বয়সে তাঁর মাথায় এল, পরিবেশ রক্ষার জন্য লেগে পড়তে হবে। অমনি তিনি যৌবন ফিরে পেলেন।
এবার আসি মাহাথির মোহাম্মদের আলোচনায়। জুলাই মাসে তাঁর বয়স ৯৩ পূর্ণ হবে। এর মধ্যে তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। এবার তিনি নির্বাচন করেছেন নিজের গড়া দলের বিরুদ্ধে, বিরোধী দলের হয়ে। সম্ভবত তিনি কবি হেলাল হাফিজের কবিতার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন: এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। অথবা শুনতে পেয়েছিলেন কাজী নজরুলের আহ্বান: কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
তিনি তাঁর যৌবন ধরে রাখার গোপন রহস্য জানিয়েছেন স্ট্রেইট টাইমসকে।
আর তা হলো কম খাওয়া। কম ক্যালরির খাবার খাওয়া।
তিনি বলেছেন, গবেষকেরা দেখিয়েছেন, যে বাঁদর কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খায়, সে বেশি দিন বাঁচে।
তিনি কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খান। মদ্যপান করেন না। ধূমপান করেন না।
তিনি বলেন, ৩০ বছর আগের শার্ট-প্যান্টও আমি ঠিকঠাক এখনো পরতে পারি।
তিনি বলেন, লোকেদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, তারা বেশি খায়, মোটা হয়, তাদের ভুঁড়ি হয়। তখন তারা মদ্যপান করতে আরম্ভ করে, আরও খায়। এসব তাদের হৃদযন্ত্রের ওপরে চাপ ফেলে। আমি কম খাই, যতটুকুন না খেলেই নয়। ৩০ বছর ধরে আমার ওজন ৬২ কেজি থেকে ৬৪ কেজি।
তিনি বলেন, লোকে বলে, আমার ঘুমানো উচিত, বিশ্রাম নেওয়া উচিত, পরপারের কড়ি সঞ্চয় করা উচিত। আমার মনে হয়, এটা বেশ স্বার্থপরের মতো কাজ হবে।
তাহলে এই রচনা পড়ে আমরা কী শিখলাম?
যদি মাহাথির হতে চাও, কম খাও।
কী শিখলাম?
কম খাও, কম খাও, কম খাও।
কিন্তু আবদুল হাই তো আমাদের কথা শুনবে না।
লুৎফর রহমান রিটন লিখেছিলেন:
আবদুল হাই
করে খাই খাই
এক্ষুনি খেয়ে বলে কিছু খায় নাই…
গরু খায় খাসি খায়
টাটকা ও বাসি খায়
আম খায়
জাম খায়
টিভি প্রোগ্রাম খায়।

আমরা বানাতে পারি-

ভাত খায় মাছ খায়
ভূমি আর গাছ খায়
বন খায় নদী খায়
যদি আর গদি খায়
পানি খায় ট্যাংক খায়
মাঝে মাঝে ব্যাংক খায়…

আমাদের পরামর্শ কম খান, আর কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খান। দীর্ঘজীবী হবেন, ৯৩ বছর বয়সে নির্বাচনে জিততে পারবেন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *