‘মামা আমি মনে হয় মইরাই যামু’

Slider শিক্ষা

314311_125

‘মামা আমি মনে হয় আর বাঁচতাম না। মইরাই যামু। এত পড়া দেখলে ডর লাগে। এত পড়া কিভাবে শেষ করতাম। কিছু মনে থাকে না। পরীক্ষা ভালো হইত না।’

কথাগুলো পঞ্চম শ্রেণীর ১১ বছর বয়সী এক ছাত্রীর; যে কি না আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে। সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে ছোট ছোট শিক্ষার্থী যে কী পরিমাণে আতঙ্ক আর অস্থিরতায় দিন পার করছে; তা ফুটে উঠেছে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর ওই কথাগুলোর মাধ্যমে। ভৈরবে বসবাসরত পঞ্চম শ্রেণীর ওই শিক্ষার্থীর মামা সারওয়ার থাকেন ঢাকায়। সারওয়ার সম্প্রতি ফোন করেন তার ভাগ্নীর পড়ালেখার খোঁজ নিতে। তখন তার ভাগ্নী খুবই হতাশার সুরে এ কথাগুলো জানায় তাকে।

ঢাকার বনশ্রীতে বসবাসরত সারওয়ার এ প্রতিবেদকের কাছে তার ভাগ্নীর আর্তনাদের কথা তুলে ধরেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সারওয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাগ্নীর কথায় আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। পরীক্ষা আর পড়ালেখা নিয়ে কেন এত উদ্বিগ্ন তা জানার জন্য আমার বোন আর ভাগ্নীর সাথে আরো কথা বললাম। তারা আমাকে জানালেন বই খুবই কঠিন। আমার বোনের কথায় বুঝলাম সেও বেশ চিন্তিত আর অস্থির আমার ভাগ্নীর পড়ালেখা নিয়ে। পড়ালেখা আর পরীক্ষা নিয়ে কেন তারা এত চিন্তিত তা জানার জন্য আমি আগ্রহী হয়ে ইন্টারনেটে পঞ্চম শ্রেণীর বইগুলো দেখলাম। সত্যিই বইগুলো খুবই ভারি আর কঠিন মনে হয়েছে আমার কাছেও। বিশেষ করে গণিত, সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজি প্রভৃতি পাঠ্যবই দেখে আমি অবাক হয়েছি। পঞ্চম শ্রেণীর গণিতে যেসব বিষয় রয়েছে; তাতে আমি আতঙ্কিত না হয়ে পারলাম না। এসব গণিত আমরা হাইস্কুল লেভেলে করেছি। আর অন্যান্য বইয়ে এমন সব বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে, যা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর জন্য বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে।

সারওয়ার জানান, আমার বোন আমাকে জানিয়েছেন বই যেমন কঠিন; তেমনি কঠিন পরীক্ষার প্রশ্ন।
আমি জানতে চাইলাম কী ধরনের প্রশ্ন আসে পরীক্ষায়। এরপর সে আমাকে গাইড থেকে গত কয়েক বছরের কিছু প্রশ্ন সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিলো। সত্যিই আমি অবাক হলাম এত ছোট শিশুদের এত কঠিন পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি গ্র্যামারবিষয়ক যেসব প্রশ্ন আসে তা তাদের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়।

আমি আমার ভাগ্নীর আতঙ্কিত হওয়ার কারণ খুব সহজেই বুঝতে পারলাম। সত্যিই তার মতো অন্যান্য শিক্ষার্থীর জন্য আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

রাজধানীর বাসাবোতে বসবাসরত এক অভিভাবক জানান, আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম। আমার পঞ্চম শ্রেণী পড়–য়া মেয়েকে নিজেই গণিতসহ সব বিষয় পড়াই। নানাভাবে গণিত বোঝানোর চেষ্টা করি। নিজে তার সামনে অঙ্ক করি। কোনো বিষয়ে বেশ কয়েকটি অঙ্ক করানোর পরও তাকে একই বিষয়ের কোনো অঙ্ক করতে দিলে সে তা ঠিকমতো পারে না। এর কারণ গণিত বইটি এমন ভারী আর কঠিন করা হয়েছে, তা তাদের বয়সের উপযুক্ত নয়। সারা বছর সারা দিন পড়ালেখা করালেও বই মনে হয় শেষ হবে না। অনেক সময় আমি নিজেই হাঁপিয়ে উঠি। গণিত ছাড়াও অন্যান্য বইয়ে এমন সব বিষয় রয়েছে, যা শিক্ষার্থীরা নিজেরা পড়ে কিছুই বোঝে না। সব কিছুই তাদের বুঝিয়ে দিতে হয়। পড়ার সময় কাছে বসে থাকতে হয়। বইয়ে এমনসব বিষয় রয়েছে যার প্রতিটি লাইন পড়ার সময় তার সন্তান প্রশ্ন করে আম্মু এটার মানে কী, আম্মু ওটার মানে কী। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি পেরেশান।

আর সৃজনশীলের কারণে এখন অনেক বেশি মুখস্ত করাতে হয়। যেমন আগে বাংলায় একটি কবিতার প্রথম আট বা দশ লাইন লিখতে আসত। কিন্তু এখন এমনভাবে পশ্ন করে, পুরো কবিতাটি মুখস্ত না করলে কবিতার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। হয়তো শেষের দিক থেকে একটি লাইন তুলে দিয়ে পরের লাইনটি লিখতে বলা হলো। পুরো কবিতা মুখস্ত না করলে এটা কিভাবে লিখবে তারা?
এভাবে আরো অনেক কিছু এখন আগের চেয়ে বেশি মুখস্ত করতে হয়। বই কঠিন হওয়ার কারণে তারা সব কিছু ঠিকমতো বুঝতে পারে না এবং সে ক্ষেত্রে মুখস্ত করা ছাড়া গতি নেই।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাসরত আরেক অভিভাবক আবিদ এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন গত বছর তার ছেলের জেএসসি পরীক্ষার সময় ভীতিকর পরিস্থিতির কথা।

তিনি বলেন, জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে তার ছেলে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। পরীক্ষার আগে সে অনেক পড়া ভুলে যেতে থাকে। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে সে রীতিমতো কাঁপতে থাকে। সামনে যাকেই পায় কেবল বলতে থাকে আঙ্কেল আমার জন্য দোয়া করেন, আন্টি আমার জন্য দোয়া করেন। আমরা তাকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম শান্ত থাকার জন্য, এত ভয় না পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে তেমন শান্ত করা যায়নি। আমার ছেলের এ অবস্থা দেখে আমি এবং আমার স্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তার বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়ে না যায়। তবে আল্লাহর রহমতে সে মোটামুটিভাবে পরীক্ষা দিয়েছে।

আবিদ বলেন, আমি জানি আমার ছেলের মতো আরো অনেক পরীক্ষার্থী এভাবে অস্থিরতায় ভুগছেন সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে।
সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী যেমন আতঙ্কিত আর উদ্বিগ্ন তেমনি অস্থিরতার মধ্যে আছেন তাদের অভিভাবকেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *