কী হতে যাচ্ছে আসামে

Slider সারাবিশ্ব

306623_111

 

 

 

 

সবুজ আসাম কি আবার লাল হয়ে উঠছে? আসামের লাখ লাখ মুসলমানকে বিতাড়ন করা হবে- এ ধরনের একের পর এক খবরে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে কী হতে যাচ্ছে সেখানে। এ প্রশ্ন এখন শুধু ভারত, বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলের মানুষের নয়; বরং সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন থেকে বিতাড়িত করা। রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে আসাম কি আরেকটি রাখাইন হতে যাচ্ছে? সেখানকার মুসলমানরাও কি বরণ করতে যাচ্ছেন অসহায় রোহিঙ্গাদের পরিণতি?

আসামের মুসলমানদের নিয়ে সম্প্রতি যেসব খবর সামনে এসেছে তাতে এখন অনেকের কপালের ভাঁজ স্পষ্ট হয়েছে। আর আসামের মুসলমানদের বিতাড়নবিষয়ক প্রতিটি খবরের সাথেই সামনে আসছে বাংলাদেশের নাম। যেমনটি হয়েছে রোহিঙ্গাদের বেলায়। ফলে আসামবিষয়ক খবর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশের পাঠক-শ্রোতাদের কাছে।

চলতি বছরের শুরুতে আসামের বৈধ নাগরিকদের তালিকা প্রকাশ, গত ফেব্রুয়ারিতে আসামের মুসলমানদের বিষয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্য এবং সর্বশেষ গত বুধবার আসাম সরকারের পক্ষ থেকে মুসলমান বিতাড়ন বিষয়ে যে চূড়ান্ত বক্তব্য দেয়া হয়েছে তাতে এটি স্পষ্ট, সুদূরপ্রসারী এক সঙ্কট ঘনীভূত এ অঞ্চলে। আর না চাইলেও এতে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
গত বুধবার আসামের অর্থ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এনআরসির (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন) তালিকায় যাদের নাম নেই তাদের অবশ্যই বিতাড়ন করা হবে।

গতকাল শনিবার এ তালিকা প্রকাশের কথা। মন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক তালিকা প্রকাশের আগে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন করবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো সুযোগ কিংবা অজুহাত গ্রহণ করব না, যাবতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে তিনি জানান, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের থাকতে দেয়া হবে।
গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে আসাম সরকার রাজ্যের বৈধ নাগরিকদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাতে বৈধ নাগরিক হিসেবে এক কোটি ৯০ লাখ লোকের নাম রাখা হয়। অথচ ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসামের লোকসংখ্যা ছিল তিন কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার। বর্তমানে আসামের জনসংখ্যা তিন কোটি ৩০ লাখ ধরা হয়। সে হিসাবে ৩১ ডিসেম্বর রাতে প্রকাশিত তালিকায় এক কোটি ৪০ লাখ লোককে অবৈধ হিসেবে দেখানো হয়। তালিকার বাইরে রাখা এ এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে অল্প কিছু বাদে সবাই মুসলমান। আসাম সরকারের অভিযোগ- তারা বাংলাদেশী এবং অবৈধ। বিতাড়ন করা হবে এসব বিদেশী অবৈধ নাগরিককে।

গত ৩১ ডিসেম্বর এ তালিকা প্রকাশের পরপরই খবর ছড়িয়ে পড়ে আসাম থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি মুসলমান। এরই মধ্যে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত দিল্লিতে একটি সেমিনারে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বলেন, আসামে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে। আর এ কাজে সহায়তা করছে চীন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের পাঠানোর ফলে আসামে যেখানে কয়েক বছর আগেও মাত্র পাঁচটি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এখন সে রাজ্যে আট থেকে ৯টি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
ভারতীয় সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যকে বিভিন্ন মহল সুদূরপ্রসারী বলে আখ্যায়িত করেন। সাধারণত ভারতের মতো দেশে সেনাপ্রধানের পদে থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যায় না। কিন্তু তিনি রীতিমতো বিভিন্ন দলের নাম নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে পুরোপুরি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে এবং এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন অনেকে। অনেকের মতে এ বক্তব্যে এটি পরিষ্কার যে, এ অঞ্চলে আরেকটি বড় ধরনের উদ্বাস্তু সঙ্কট আসন্ন।

গত ফেব্রুয়ারি থেকেই গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, আসাম সরকার বড় আকারের বন্দিশিবির তৈরি করছে। যদি মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাতে না পারে তবে তাদের বন্দিশালায় রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।
১৯৮০ সালের পর থেকে ক্রমাগত আসামে বিদেশী খেদাও আন্দোলনের পর থেকে ১৯৮৫ সালে একটি প্রস্তাব পাস হয়। তাতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে যারা এখানে বসবাস করে, তারা আসামের নাগরিক। এ সমেয়র পরে যারা এখানে প্রবেশ করেছেন তারা বিদেশী নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে।

সর্বশেষ নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের শর্তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা পরিবার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দাবি করতে হলে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, তারা উল্লিখিত সময়ের আগ থেকেই আসামে অবস্থান করছে।
২০১৬ সালে আসামে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। তারপর থেকেই তারা তালিকার বাইরে থাকা লোকদের বিদেশী আখ্যায়িত করে আসাম থেকে বিতাড়নের অঙ্গীকার করে। দুই বছর ধরে একটি তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। এর উদ্দেশ্য হলো ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে কারা আসামে ছিলেন এবং কারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাদের শনাক্ত করা। এরপর তাদের ভাষায় যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাদের আসাম থেকে বিতাড়ন করা।

গত বৃহস্পতিবার আলজাজিরায় প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, যেসব লোক ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনের (এনআরসি) কাছে তাদের যথাযথ তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেননি তাদের ব্যাপারে প্রাথমিক প্রতিবেদন আগামী শনিবার প্রকাশ করতে যাচ্ছে আসাম কর্তৃপক্ষ। বিগত ছয় দশকে এই প্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার যে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা তাতে আসামে বসবাসরত প্রায় ৪৮ লাখ লোক তাদের যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বুধবার আসামের অর্থ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এনআরসির তালিকায় যাদের নাম নেই তাদের অবশ্যই বিতাড়ন করা হবে।’ এ খবর প্রকাশের পর মারাত্মক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে আসামে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে।

নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে পারেননি এমন ৪৮ লাখ মুসলমানের তালিকা প্রকাশের তথ্য সরকারিভাবে স্বীকারের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৫০ লাখ মুসলমান বিতাড়নের শিকার হতে যাচ্ছে আসাম থেকে। বাংলাদেশের উত্তরে লালমনিরহাট জেলার সাথে সীমান্ত রয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যের।

১৯৩০ সাল থেকে আসামে বসবাস করে আসছেন এমন লোকের নামও ৩১ ডিসেম্বরের তালিকায় ওঠেনি খবর প্রকাশিত হয়েছে। আবার ১৯৪২ সাল থেকে আসামে বসবাস করে এলেও তাদের অনেকের কাছে তা প্রমাণের যথেষ্ট কাগজপত্র নেই। অনেকে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই আসামে বসবাস করে আসছেন কিন্তু তা প্রমাণের পর্যাপ্ত কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। ফলে তাদের নাম তালিকায় আসেনি। তালিকায় নাম না আসায় কাছাড় জেলার হানিফ নামে এক যুবকের আত্মহত্যার খবরও প্রচারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
তালিকায় না থাকা আসামের মুসলমানদের বাংলাদেশী অবৈধ নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের আসাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ার খবরে অনেকে ইতোমধ্যে আশঙ্কা করেছেন সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আসাম হতে পারে মিয়ানমারের আরেকটি আরাকান। আসামের মুসলমানদের পরিণতি হতে পারে রোহিঙ্গাদের মতো। জীবন বাঁচাতে আসামের মুসলমানরা ছুটে আসতে পারেন বাংলাদেশে।

ভারতে লাখ লাখ লোককে রাষ্ট্রহীন ঘোষণার আয়োজন চলছে মর্মে ভারতেরই সাংবাদিকদের পাঠানো বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমে। আগামী জুন মাসের মধ্যে আসামে নাগরিকদের তালিকা প্রকাশের কাজ সম্পন্ন করার আদেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

১৯৮০ সাল থেকে আসামে বিদেশী খেদাও আন্দোলন জোরদার হয়। এরপর থেকে সেখানে অনেকবার মুসলমান অধিবাসীদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখনো মাঝে মধ্যে আসামে মুসলমানদের হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া বিদেশী খেদাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে এক দিনে আসামে ৮০০ মুসলমান হত্যার নজির রয়েছে।

এ দিকে আসাম থেকে মুসলমানদের বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বিতাড়নের ক্রমাগত হুমকি এবং সর্বশেষ আসাম সরকারের তালিকা প্রস্তুতির খবরে অনেকে বাংলাদেশ-ভারত মধুর সম্পর্ক বিষয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলেছেন, ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। কিন্তু তারপরও ভারতের এ আচরণ কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না।
আসামের মুসলমানদের যাতে রোহিঙ্গাদের পরিণতি বরণ করতে না হয় সে লক্ষ্যে এখনই বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত বলে দাবি অনেকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *