সিরিজ শ্লীলতাহানির ঘটনায় তোলপাড়

Slider সারাদেশ

108263_f1

 

ঢাকা: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বুধবার আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের হাতে বিভিন্ন স্থানে নারীদের হেনস্থা ও লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নগরীর বাংলামোটর, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, কাকরাইল, খামারবাড়ি ও কলাবাগানে এসব ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ফেসবুকে এ ধরনের তথ্য প্রকাশের পর এ নিয়ে তোলপাড় চলছে। হেনস্থার শিকার কয়েক নারীর স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা।

তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভিটিও ফুটেজ সংগ্রহের কথা জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারাও। বাংলামোটরে এক কলেজছাত্রী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী মাইনুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসে নি। যদি তারা অভিযোগ না করে তবে আমরা তাকে আইনি সহায়তা কীভাবে দেব? এ ছাড়া সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ওই শিক্ষার্থীর সহযোগিতা দরকার। কাজী মাইনুল আরো বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করেও আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। তদন্তে যদি লাঞ্ছিত হওয়ার কোনো প্রমাণ ও লাঞ্ছনাকারীদের শনাক্ত করা যায় তবে নিরপেক্ষভাবেই তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

বাংলামোটরে লাঞ্ছিত হওয়া শিক্ষার্থী বুধবার ঘটনার পরপরই এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘শান্তিনগর মোড়ে এক ঘণ্টা দাঁড়ায়ে থেকেও কোনো বাস  পাইলাম না। হেঁটে গেলাম বাংলামোটর। বাংলামোটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাঁড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পরা একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেছে, এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেছে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেছে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিছে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে এন্ড একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফ্লি আসছি।’ পরে অবশ্য আর স্ট্যাটাসটি দেখা যায়নি। রাতে ওই শিক্ষার্থী আরো লিখেছেন, ‘ভালো আছি, সুস্থ আছি। পোস্টটা অনলি মি করেছি, কারণ পোস্টটা রাজনৈতিক উস্কানিমূলকভাবে শেয়ার করা হচ্ছিল। আমি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশে পোস্টটা  দেইনি। প্লাস আমার কলেজকে জড়ানো হচ্ছিল এ ব্যাপারে। ব্যাপারটার সঙ্গে আমার কলেজের কোনো সম্পর্ক নাই।’  এই শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত হওয়ার পরে তার দেয়া স্ট্যাটাসটি কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই ভাইরাল হয়ে পড়ে। এরকম অভিযোগ ওঠার পর থেকে সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী রমনা মডেল থানায় অনেকেই যোগাযোগ করেন। আইডিটি সঠিক কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠে। এবিষয়ে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে। ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বাংলামোটরের ঘটনায় লাঞ্ছিত হয়েছে এমন অভিযোগে দেয়া স্ট্যাটাসের আইডিটি আমরা খতিয়ে দেখেছি। আইডিটি ভুয়া নয়। অরিজিনাল আইডি। আইডিতে তার ব্যক্তিগত সকল তথ্যই দেয়া আছে। আমরা তার সঙ্গে কথাও বলেছি।

আরেক নারী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘খুব মজা সমাবেশ করতে যেতে আসতে, রাস্তায় গ্রুপ হয়ে মেয়েদের হ্যারাস করা!!! এক মুরব্বি বলেছেন, ঠিকই আছে, বের হইছো কেন বাসা থেকে জানো না আজকে রাস্তায় বেশি ছেলে থাকবে!? তিনি আরো লিখেছেন, ‘আল্লাহ কেন মেয়েদের মাত্র দুটি হাত দিলো, দুটো হাত দিয়ে এতগুলো হাত থেকে বুক পেট বাঁচাবো নাকি কোমর পিঠ বাঁচাবো, ওড়না ধরে রাখবো নাকি তাদের হাতগুলো সরাবো।

শহীদ মিনার ও চারু কলার সামনে লাঞ্ছিত হওয়া এক নারী লিখেছেন,  হল থেকে বের হয়ে কোনো রিকশা পাইনি, কেউ শাহবাগ যাবে না, হেঁটে শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে হয়েছে, আর পুরোটা রাস্তাজুড়ে ৭ই মার্চ পালন করা দেশভক্ত সোনার ছেলেরা একা মেয়ে পেয়ে ইচ্ছে মতো টিজ করছে, নোংরা কথা থেকে শুরু করে যেভাবে পারছে টিজ করছে। বহু হয়রানির পর রিকশা নিয়ে শহীদ মিনার থেকে শাহবাগ আসছি। এতেও রক্ষা নাই। চারু কলার সামনে একদল ছেলে পানির বোতল থেকে পানি ছিটাইছে গায়ে, প্রায় আধা ভিজা করে দিছে। যখন রাগ হচ্ছিলাম তখন তো একজন রিকশার পেছন থেকে চুল টেনে দৌড় দিছে। সিরিয়াসলি!!! রিকশা থেকে নামতে চাইছিলাম জুতাবো ওইটাকে তাই। পাশের রিকশার ভদ্রলোক খুব ভদ্রভাবে না করলো তাই নামিনি। গৌরবময় ৭ই মার্চ সোনার ছেলেরা এত ভালোভাবেই পালন করছে যে নিজের ক্যাম্পাসেই হ্যারাস হতে হয়।’ তিনি আরো লিখেছেন, ও হ্যাঁ কেউ যেন আবার বলতে আসবেন না, জানেনই তো আজ ঝামেলা হবে বের হতে গিয়েছেন কেন!!!

অপর এক নারী লিখেছেন, আজকের রাস্তা যে কি ছিল তা টের পাইছি ফার্মগেট থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে। শাহবাগ গিয়ে দেশের সোনার ছেলেদের টিজিংতো ছিলই। সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত একা হেঁটে এসেছি আর পুরো রাস্তা ৭ই মার্চ পালন করতে আসা ছেলেদের শুধু অসাধারণ সব নোংরা কথা ও শিসের আওয়াজ শুনেছি। তিনি লিখেছেন, পারিবারিকভাবে আমি লীগের সমর্থক। শেখ হাসিনাকে মনেপ্রাণে নেত্রী মানি। কিন্তু এইসব ছেলেরা লীগের মান-ইজ্জত ডুবাচ্ছে, কিছুদিন পর আর লীগ সমর্থক পরিচয় দিতে লজ্জা লাগবে।  বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার ঐতিহাসিক ভাষণের দিনে এই করুণ অবস্থা দেখে কতটা কষ্ট পাবেন ভাবলেই কষ্ট লাগে। হোমপেজে এসে দেখি আমি একা নই, আরো মেয়েদের একই কাহিনী। বরং আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি কেউ আমার গায়ে হাত দেইনি।) আবার কালকে নারী দিবস। শুনবো শুধু যে নারীদের হেন অধিকার, তেন অধিকার কত কি! নারী স্বাধীনতা ব্লা ব্লা ব্লা!!! স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক আমরা।

অপর এক নারী বলেছেন, গাড়ি চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে খামারবাড়ির দিকে যাওয়ার সময় সামনে দুই তিনটা ট্রাক ভর্তি ছেলে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল। রাস্তা ফাঁকা কিন্তু তাদের ট্রাক চলছিল ধীরগতিতে এবং আমার গাড়িকে কোনোভাবেই সাইড দিচ্ছে না। এক  দুইবার আমার গাড়ি তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করতেই গাড়ির দিকে বোতল ছুড়ে মারতে থাকে তারা। আমার চালক জানালার কাচ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে অশ্রাব্য গালি। তাদের বক্তব্য আমার গাড়ি তাদের পেছন পেছন যেতে হবে।

নারী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকে তাদের নিজেদের ফেসবুকের দেয়ালে লিখছেন। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের অনুষ্ঠানকে বিতর্কিত করতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা গল্পের কথা শোনা যাচ্ছে। সত্য মিথ্যা কতটুকু জানি না। হয়তো শিগগিরই তা উদঘাটিত হবে। উল্লিখিত ঘটনার আশেপাশে সবখানে সিসি ক্যামেরা আছে। ঘটনা ঘটলে কারা কারা দায়ী ও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কি তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু হবে না। না ঘটলেও হয়তো রটনার রহস্য উদঘাটিত হবে। উত্তেজিত না হয়ে এখনই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে অপেক্ষা করাই ভালো।

ঘটনার বিষয়ে নারী অধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, স্বাধীনতার এতটি বছর পার হয়েছে। প্রতিটা সেক্টরে নারীদের বিচরণ বেড়েছে। কিন্তু এখনো মুক্তি মিলেনি। কারণ আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এমনটাই হচ্ছে। আমরা লেখাপড়া করে পাস করে চাকরি করে টাকা আয় করা, খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তি এসবই চিনি। কিন্তু সমাজের কার সঙ্গে কি আচরণ করতে হবে তা শিখিনি।  তিনি বলেন, বার বার আমরা মেয়েদের প্রতি সহিংসতা কমানোর কথা বলছি। কিন্তু কই, বেড়েই চলছে নারীর প্রতি সহিংসতা। পহেলা বৈশাখেও এধরনের ঘটনা ঘটেছে। নারীদের টিজ করার  জন্য মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্টে অনেকের শাস্তি হচ্ছে। তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই স্কুল-কলেজ, পরিবার সর্বত্রই আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা নিতে এবং দিতে। আর এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *