বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের ১১৭৩ জাতের প্রাণী

Slider জাতীয়

299104_120

 

 

 

 

সারা বিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, দ্রুত নগরায়ন, জলাভূমি জবরদখল, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী পাচার ও নিধনের ফলে অনেক জাতের প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। গত ১০০ বছরের ব্যবধানে দেশ থেকে তিন জাতের বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে এক হাজার ১৭৩ জাতের প্রাণী।
এদিকে বন্যপ্রাণী রক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ^ বন্যপ্রাণী দিবস উপলক্ষে আজ গাজীপুরে মাস্টার বাড়িতে বর্ণাঢ্য শিশু-কিশোর সমাবেশ ও এ বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘বাঘগোত্রীয় প্রাণীরা আজ বিপন্ন, এদের রক্ষায় এগিয়ে আসুন’।

বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের লাল তালিকা প্রণয়ন করেছে। ২০১৫ সালে করা ওই তালিকায় ২৫৩ জাতের মিঠাপানির মাছ, ৪৯ জাতের উভচর, ১৬৭ জাতের সরীসৃপ, ৫৬৬ জাতের পাখি ও ১৩৮ জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী লাল তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই তালিকাভুক্ত প্রাণীদের ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা না হলে অচিরেই অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ এক সময় বাংলাদেশ প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল।

সংস্থাটি ২০১২ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ৬৩ হাজার ৮৩৭ জাতের প্রাণীর বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করেছে। এর মধ্যে ১৯ হাজার ৮১৭টি হুমকির সম্মুখীন, তিন হাজার ৯৪৭টি মহাবিপন্ন, পাঁচ হাজার ৭৬৬টি বিপন্ন এবং ১০ হাজার সঙ্কটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় আছে। এর মধ্যে ৪১ ভাগ উভচর, ৩৩ ভাগ প্রবাল, ২৫ ভাগ স্তন্যপায়ী এবং ১৩ ভাগ পাখি রয়েছে।
এদিকে সংস্থাটির ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১০০ বছরের ব্যবধানে আমাদের দেশ থেকে তিন জাতের বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১১টি স্তন্যপায়ী, ১৯টি পাখি ও একটি সরীসৃপ। বিলুপ্ত বন্যপ্রাণীর তালিকায় রয়েছে ভারতীয় গণ্ডার, সুমাত্রান গণ্ডার, জাভান গণ্ডার, বারশিংগা, দাগী হায়না, বনগরু, কৃষ্ণষাড়, ধূসর নেকড়ে বাঘ, নীলগাই, শ্লথ ভল্লুক, বুনোমহিষ, মিঠাপানির কুমির, সবুজ ময়ূর, ময়ূর, গোলাপি শির হাঁস, বাদি হাঁস, সারস, রাজশকুন, স্পটবিল্ড পেলিকেন, বড় মদনটাক, বাংলা ফ্লোরিকেন, ছোট ফ্লোরিকেন, বারটেলড ট্রি ক্রিপার, কালোবুক প্যারটবিল, স্পট ব্রেস্টেড প্যারটবিল, বড় প্যারটবিল, ধূসর তিতির, রোফাস থ্রটেট পারট্রিজ, রাস্ট্রি ফ্রন্টেট বারউংগ, সোয়াম্প তিতির ও সাদা বক্ষ বক।

এর আগে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে জাতিসঙ্ঘের ৮০টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে ৩৪ হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদকে বর্তমানে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বন অধিদফতরের সাবেক উপপ্রধান বন সংরক্ষক ড. তপনকুমার দে জানান, পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী ও দেহাবশেষ পাচারের পরিমাণ মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও সোনা চোরাচালান একই পর্যায়ে চিহ্নিত হয়েছে। আইভরির জন্য দাঁতাল হাতী ও গণ্ডার মারা হচ্ছে। চামড়া ও হাড়ের জন্য বাঘ মারা হচ্ছে। গোশতের জন্য হরিণ ও পাখি মারা হচ্ছে এবং এর ফলে বন্যপ্রাণীর লাল তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এর সদস্যভুক্ত এবং বাংলাদেশেও এর সদস্য। ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ জাতের প্রাণী ও ৩০ হাজার জাতের গাছগাছড়াকে রক্ষিত জাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে প্রাণী ও উদ্ভিদ রফতানি ও আমদানির ওপর বিধিনিষেধ ও শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে। তবে খামারজাত বন্যপ্রাণীর আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একসময় বন্যপ্রাণীর স্বর্গরাজ্য ছিল। ২০১০ সালে ড. আলী রেজা খান তার বইতে এক হাজার ৫৯ জাতের বন্যপ্রাণীর তালিকা প্রদান করেছেন। তার মধ্যে ৪২টি উভচর, ১৫৭ সরীসৃপ, ৭৩৬টি পাখি ও ১২৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। তবে এখানে মৎস্য জাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ড. তপনকুমার দে বলেন, বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান অরণ্য। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক মানুষ গ্রাম ও শহরের সীমা প্রসারের চেষ্টায় এবং চাষোপযোগী জমি বাড়ানোর নেশায় অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ কর্তন করে অরণ্যকে করে তুলেছে বন্যপ্রাণী বাসের অনুপযোগী। ছোট ছোট বন ও বনভূমি কেটে শস্যক্ষেত্র, রাস্তাঘাট, কলকারখানা গড়ে উঠেছে।
এর ফলে বন্য পশু-পাখির পরিবর্তে গৃহপালিত পশু-পাখির সংখ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুদিন আগেও যেসব পশু-পাখি অবাধে বনে ঘুরে বেড়াত তারা আজ প্রায় বিলুপ্ত।

এ ছাড়া কম পরিশ্রমে বেশি উপার্জনের নেশায় মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর মানুষ। বন্যপ্রাণীদের তারা যথেচ্ছভাবে হত্যা করে চলেছে। গভীর অরণ্যে বাঘ, চিতা, কচ্ছপ, গুইসাপ, বনমুরগিসহ নানা জাতের হরিণও আজ বিলুপ্তির পথে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিগত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশে শিকারযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনে এককালে একশিং গণ্ডার, বাঘ ও চিত্রল হরিণ পর্যাপ্ত পরিমাণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সুন্দরবনে গণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বাঘ ও হরিণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাঘের চামড়ার ভালো বাজার দর থাকায় শিকারিরা চোরাপথে বনের বাঘ শিকার করে থাকে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে হাতির দল খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বারবার। এতে মানুষের জমির শস্য নষ্ট হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে এবং মানুষের প্রাণহানিও ঘটছে প্রতি বছর।

এদিকে ২০১৫ ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বাঘ ও বাঘের আবাসস্থল সুরক্ষার জন্য একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দেশে মহা বিপদাপন্ন হাতীর সংখ্যা প্রায় ২০০-৩৫০টি (আবাসিক ও অনাবাসিক)। এদের সংরক্ষণের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে জীবজন্তুদের অবদান অনস্বীকার্য এবং এর নান্দনিক মূল্যও অপরিসীম। বর্তমানে বন কেটে বসতি গড়ে উঠছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর বনভূমি নষ্ট হচ্ছে। তার ফলে প্রায় হাজার জাতের পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী ভয়ঙ্করভাবে অবলুপ্তির পথে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুসারে বিনা অনুমতিতে পশু-পাখি ধরা, মারা ও বেচাকেনা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু সরকারি প্রশাসনের কতিপয় কর্মচারী ও আইন দ্বারা এই অবৈধ কাজ বন্ধ করা সম্ভব নয়। সে জন্য চাই সব মানুষের সহযোগিতা ও গণচেতনা বৃদ্ধি।

এ প্রতিবেদনে দেশের বন্যপ্রাণী ধ্বংসের কারণ হিসেবে শিকার, প্রতিবেশ অবস্থান বা আবাসস্থল ধ্বংস, বিদেশী আগ্রাসী জাত, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিক ব্যবহার, দূষণ, খণ্ড খণ্ড বন সৃষ্টি, জেনেটিক বেরিয়ার, নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্পের কাঁচামালের চাহিদ, বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ এবং বনভূমির বিকল্প ব্যবহার উল্লেখ করা হয়েছে।
অপর দিকে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী রক্ষার বিভিন্ন গৃহীত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বন্যপ্রাণী পরিবেশ, খাদ্যচক্র, বন ও প্রকৃতির অবিছেদ্য অংশ। ১৯২৭ সনের বন আইনে বন্যপ্রাণীকে বনজ সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি বন এলাকায় বন্যপ্রাণী ধরা, শিকার ও পাচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ বলা যেতে পারে। সরকারি বনের বাইরেও অনেক বন্যপ্রাণী আছে।

ড. তপনকুমার দে বলেন, দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ভরপুর এলাকা। বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বন্যপ্রাণীর ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রটোকল ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বন বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকলেও দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও বাজেটের স্বল্পতার কারণে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *