“ভাঁটির আকাশে সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র অধ্যাপক শাহেদ আলী”

Slider সাহিত্য ও সাংস্কৃতি
IMG_20180304_122022_514
আল-আমিন আহমেদ সালমান
:-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বাংলা সাহিত্যের ভাঁটির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র ও একজন অমর কথা শিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী। এই গুণী কথাশিল্পী ১৯২৫ সালের ২৬ মে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার  মাহমুদপুর গ্রামের এক সম্রান্ত্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেনএকাধারে, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ইসলামী চিন্তাবিদ, অনুবাদক ও গবেষক। একসময় তাঁর গল্প কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত থাকলেও বর্তমানে পাঠ্য তালিকা থেকে রহস্যজনক কারণে বাদ পড়ে যাচ্ছে। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে যে কয়জন ক্ষণজন্মা ছোট গল্পকার আমরা পেয়েছি তারমধ্যে চল্লিশ দশকের শাহেদ আলী নানা দিক বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য তিনি তার যোগ্য আসন আজ অবধি পাননি। তার যে বিষয়টির জন্য সব চাইতে শাহেদ আলীকে আমাদের পাঠ করা এবং মূল্যায়ন করা উচিত তা হলো তিনি প্রকৃত অর্থে পূর্ব বাংলার বাঙালী মুসলিম জীবনের স্বার্থক রূপকার।
শাহেদ আলীর গল্পের ভেতর দিয়ে ভাঁটি বাংলার মুসলিম জীবনের সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না, জীবন যাপনের নানা প্রতিকূলতা, সংগ্রাম ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া যায়। অধ্যাপক শাহেদ আলীর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে:একমাত্র পথ (১৯৪৬),তরুণ মুসলিমের ভূমিকা (১৯৪৬),ফিলিস্তিনে রুশ ভূমিকা (১৯৪৮),সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া (১৯৫০),তরুণের সমস্যা (১৯৬০)
বাংলা সাহিত্যে চট্রগ্রামের অবদান (১৯৬৫),তওহীদ (১৯৬৫),বুদ্ধির ফসল,আত্মার আশিষ (১৯৭০),ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা (১৯৭০),Economics Order of Islam (১৯৭৮),জীবন নিরবচ্ছিন্ন (১৯৮০),রুহীর প্রথম পাঠ (১৯৮০),ছোটদের ইমাম আবু হানিফা (১৯৮০),Islam in Bangladesh (১৯৮১),সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ (১৯৯২) ইত্যাদি।
অনুবাদ কর্মের মধ্যে রয়েছে:
মোহাম্মদ আসাদ রচিত ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারী পরিচালনার মূলনীতি (১৯৬৬),মক্কার পথ (১৯৬৬)
কে বি এইচ কোনা রচিত আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ,
হিরোরডাটাস রচিত “ইতিবৃত্ত” (১৯৯৪) ইত্যাদি।
তার একমাত্র উপন্যাস “হৃদয় নদী” ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নাটিকা “বিচার” ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থ “জীবন দৃষ্টি সাম্প্রদায়িকতা”, ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ “বিপর্যয়ের হেতু” প্রভৃতি। শাহেদ আলীর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ছয়টি। প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ট গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে “জিব্রাইলের ডানা”। স্বপ্ন ও বাস্তবতার দুই জগৎ নিয়ে মানুষের জীবনের যে প্রতিদিনের টানাপড়েন এবং গতিমান জীবনের সঙ্গে যে দ্বন্ধ তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে শাহেদ আলী তাঁর “জিব্রাইলের ডানায়” তুলে ধরেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আলোড়িত এই গল্পটি নিয়ে ভারতের ৫ জন চলচিত্রকার ফিল্ম নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন – ভূবন বিজয়ী ফিল্ম নির্মাতা সত্যজিত রায়। এছাড়া ছিলেন ঋত্মিক ঘোটক, মৃণাল সেন,জ্যোতির্ময় রায় এবং নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও বামপন্থি বুদ্ধিজীবিদের চক্রান্তে তাদের পরিকল্পনা প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনি। লেখকের দ্বিতীয় গল্প গ্রন্থ ১৯৬৩ সালে ১০ টি গল্প নিয়ে “ একই সমতলে” প্রকাশিত হয়। গল্পগুলো হল সিতারা, পুতুল, মা, বমি, কান্না, অহেতুক, বন্যান, মহাকালের পাখনায়, দ্বীন ব্রাদার্স ও একই সমতলে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ৮টি গল্প নিয়ে তৃতীয় গল্পগ্রন্থ “ শা’নযর” গল্পগুলো হল- নীল ময়না, জননী, কবি, নেপথ্যে, ছবি, মন ও ময়দান, নোঙর ও শা’নযর। এর মধ্যে “মন ও ময়দান” ভাষা আন্দোলনের উপর প্রকাশিত প্রথম গল্প। ৬টি গল্প নিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় লেখকের চতুর্থ গল্পগ্রন্থ “অতীত রাতের কাহিনী” গল্পগুলো হলো- পৃথিবী, ইটের পর ইট, রাত অন্ধকার, সোনাখালী, মানুষের মানচিত্র ও অতীত রাতের কাহিনী। ১৭টি গল্পের সংকলন নিয়ে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় পঞ্চম গল্পগ্রন্থ “ অমর কাহিনী”। গল্পগুলো হলো- ইঙ্গিত, একটি আধুনিক অমর কাহিনী, সায়েরা বানুর চিকিৎসা, আড়াল, মনসব মিয়ার স্বস্তি, কপাল, পাগল, শয়তান, রুমের সুলতান, অভিযান, বোবা যন্ত্রনা, দাবী, লুকাস, বরকতুল্লাহ আলাইহে, নতুন চর, ভয়ংকর ও সর্বনাশ। ৯টি গল্প নিয়ে তার ৬ষ্ঠ ও সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ “ সোনার খনি” প্রকাশিত হয়। গল্পগুলো হলো- নতুন জমিনদার, একটি রিপোর্ট, অন্তরাগ, আরো একটি রিপোর্ট, নতুন কমিশন, শহীদে কারবালা, ঘাতক, নিরুত্তর ও সোনার খনি। শাহেদ আলীর অগ্রন্থিত গল্পের মধ্যে রয়েছে- বিচার্স স্কলার, অশ্র,এই আকাশের হাওয়া, ছিন্নপত্র, হাসি-কান্না, পিটিশন, সোনার চেয়ে দামী, তুচ্ছ, আপন বিদায়, মানহানি, ময়না তদন্ত প্রভৃতি।
এই বহুমূখী প্রতিভাবান কথাশিল্পী ১৯৬৪সালে ছোট গল্পের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার , ১৯৮১ সালে ভাষা আন্দোলন পদক, ১৯৮৯ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, ২০০০ সালে তমুদ্দিন-মজলিস মাতৃভাষা পদক ও জাসাস স্বর্ণপদক (মরণোত্তর), ২০০৩ সালে কিশোর কন্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর) সহ অসখ্য পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালে তিনি মালেশিয়ায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবে বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত একমাত্র সাহিত্যিক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন।
এই গুনী কথা সাহিত্যিক ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর মৃত্যু বরন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *