মন্দবাসা

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

mondobasha-1417337478ভালোবাসা সব সময় স্বাস্থ্যকর নয়। কখনও কখনও তা মন্দও বটে। আপনি মানুন আর নাই মানুন, তাতে কি যায় আসে অর্পিতার। সে তার মতের বাইরে যেতে নারাজ। এটা তার মনে বদ্ধমূল। এ যেন তার জীবনের একটা দর্শন। বন্ধু মহলে এ নিয়ে তাকে সবাই একটু বাঁকা চোখেই দেখে। অনেকেই কানাঘুষা করে, মেয়েটির হয়তো অন্য কোনো দোষ আছে। নইলে ভালোবাসার কথা শুনলেই এমন রেগে যাবে কেন!

প্রেম মানে বিষফোঁড়া। তার যেসব বন্ধুরা প্রেম করে তাদের এটা হরহামেশাই মনে করিয়ে দেয় সে। ‘আর যাই করিস প্রেম করিস না। প্রেম মানেই এক্সটা কেয়ার। চোখের আড়ালে গেলেও প্রেমের শাসনে বাঁধা থাকে মন। সব কিছুই কেমন যেন সিক্রেট হয়ে যায় জীবনের। কিন্তু জীবন মানে তো খোলা হাওয়া। মুক্ত আকাশ। প্রাণখোলা হাসি। যখন ইচ্ছা তখনই পাখিদের মতো ওড়াউড়ি। সেই জীবনকে একপাশে রেখে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে সারাক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বন্ধু বান্ধব, এমন কি পরিবারও কেমন যেন পর হয়ে যায়’। এর সবই তো জানা আছে অর্পিতার! তাহলে কি ঘর পোড়া গরুর মতই সে!

এক ডজন ছেলে বন্ধু আছে অর্পিতার। তাদের কেউ সহপাঠী। কেউ কেউ আবার উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার পাশে। তাদের সঙ্গে অর্পিতা গল্প করে- ফোনে, ফেসবুকে। ঘুরতেও যায় কোনো কোনো দিন। নাম করা রেস্টেুরেন্টে বসে মজার মজার খাবার খায়। তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে তা পোস্ট করে ফেসবুকে। বিষয়টি অনেকে বাঁকা চোখে দেখলেও মানুষ হিসেবে খোলা মনের মেয়েটি। সে এসব করে জীবনকে উপভোগ করতেই। তার মনে অন্য কোনো বাসনা নেই। আসলে তার কাছে জীবন মানে- ‘খাও দাও, ফুর্তি কর’।

এই মেয়েটির যে কোনো দুঃখ থাকতে পারে এটা কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। অথচ অর্পিতা বৃষ্টি দেখলেই অন্য রকম হয়ে যায়। তার ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিভে ভিজে আইসক্রিম খেতে। শীতে ঝড়ে পড়া পাতার মতো কুঁকড়ে যায় সেও। কোনো বিকেলে একা হলেই নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নেয়। যখন ঘরে একা থাকে তখন আনমনে কিছু একটা ভাবে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলেও হঠাৎ হঠাৎ চেতনা হারা মনে হয় তাকে। এমন হলে কেউ হয়তো পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই আজ কী হয়েছে রে তোর’? বাতাসের ঝটকায় হঠাৎ উড়ে যাওয়া ওড়না যেভাবে টেনে নিয়ে ঠিক ঠাক করে মেয়েরা সে রকম নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, ‘না রে কিছু না তো’। মূহুর্তের মধ্যে নিজেকে বদলে ফেলার ক্ষমতা আছে তার। তাছাড়া অনেকের হাবভাবে বোঝা যায় তার মনের ভিতরে কি চলছে। অর্পিতার মনে কি, তা বোঝা যায় না কিছুতেই। নিজেকে লুকাতে দারুণ পটু ২৬ বছর বয়সী এই মেয়েটি।

সেদিনও নিজেকে নিমিষেই সামলে নিয়েছিল সে। আসলে ভালোবাসা নিয়ে আজকে মেয়েটি যা বলে বা তার ভাবনায় যা সেটি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। সেও প্রেমে পড়েছিল আট বছর আগে। তখন হয়তো অনেক কিছুই বুঝত না সে। তবে জড়িয়ে পড়েছিল একটি ছেলের সঙ্গে। পরে অবশ্য নিজে নিজেই সরে এসেছে সে পথ থেকে।

ছেলেটির কোনো দোষ ছিল না। তাহলে সব ভুলই কি ছিল অর্পিতার? না, তাও না। তাহলে কি এমন গলদ ছিল তাদের সম্পর্কে? এর উত্তর খুঁজেও কোনো কূল কিনারা পায়নি অর্পিতা। মাঝে পড়াশুনার চাপ, পারিপার্শ্বিকতা, বন্ধু, পরিবার সবাইকে নিয়ে ব্যস্তও ছিল বেশ। তবে গতকালের পর সব ওলটপালট হয়ে গেছে অর্পিতার। ছয় বছর আগের সেই ভুল ভালোবাসা তার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায়।

কীভাবে যে ছেলেটি অর্পিতাকে খুঁজে পেল! ওর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর চারটি বছর কেটে গেছে। গত চার বছরে তার কোনো খোঁজ ছিল না। ফেসবুকে বা অন্য কোথাও ছিল না সে। মোবাইলেও পাওয়া যায়নি তাকে। অর্পিতা চেতনে বা অবচেতনে বহুবার খুঁজেছে তাকে। ছেলেটির তো একটা ‘সরি’ পাওনাই ছিল। সেটিও বলতে পারেনি তাকে। আসলে ওর তো কোনো দোষ ছিল না। ছেলেটির জন্য বিনা দোষে মৃত্যদণ্ড পাওয়ার মতই ছিল বিষয়টি। সে আবার কেন যে অর্পিতার মুখোমুখি হতে চায়!

অর্পিতা জেনেছে ছেলেটি বিয়ে করেছে। তার একটি সন্তানও আছে। এটা জানার পরে অর্পিতার প্রশ্ন, ‘কেন তবে আমাকে খুঁজে বের করলে’? ফেসবুক চ্যাটিং-এ নানা কথা হয়। সবশেষে অর্পিতা ট্রিট চায় ছেলেটির কাছে। নিজে নিজেই হাসে অর্পিতা। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে। সেটা দেখতে পায় না ছেলেটি।

এই ছেলেটির সঙ্গে তার পরিচয় হয় ভুল নম্বরে মেসেজ পাঠানোর মধ্যে দিয়ে। এক বন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ছেলেটির নম্বরে চলে যায়। এর পর জল গড়ায় বহু দূর। লোনা পানি, মিঠা পানি করে করে তা একসময় প্রেমের সাগরে রূপ নেয়। বহু বিকাল-সন্ধ্যা এক সঙ্গে কাটিয়েছে তারা। কোনো দিন রেস্টুরেন্টে। আবার কখনও রিক্সা করে ঘুরেছে। এক শীতের সন্ধ্যার কথা খুব মনে পড়ছে আজ আর্পিতার। দুজন পাশাপাশি বসে ছিল রিক্সায়। হঠাৎ অর্পিতার মনে হয় ছেলেটি পাশে বসে শীতে কাঁপছে। তবে মুখে কিছু বলছে না। সেদিন একটি শাল গায়ে ছিল অর্পিতার। সে বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজের শরীর থেকে শালটি খুলে পড়িয়ে দেয় ছেলেটিকে। সে দিনের পর বহুদিন সেটি গায়ে চড়ায়নি অর্পিতা। একটা কাঁচের বয়ামে ভরে তা লুকিয়ে রেখেছিল সে। আর মাঝে মাঝে বয়ামটি খুলে ছেলেটির গায়ের গন্ধ নিত। আজও সেই শালটি বয়ামে ভরে রাখা আছে তার কাছে। যখন খুব বেশি কান্না পায় তখন সে ছেলেটির গায়ের গন্ধ খোঁজে। তবে কী কারণে ছেলেটির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল তা আজও রহস্যই। একমাত্র অর্পিতাই জানে কী সেই কারণ।

আচ্ছা, এখনো কি আগের মতই আছে ছেলেটি? তার তো সংসার হয়েছে। বউ, সন্তান নিয়ে হয়তো ভালো কাটছে তার দিনগুলো’। সত্যি বলতে কি, দিন মানুষকে বদলে দেয়। সব কিছু কি সময়ের হাতে বন্দী? সময় যেভাবে চায় সকলই সেভাবে হয়! যে ছেলেটির জন্য এক সময় জীবন পর্যন্ত দিতে পারত সেই মানুষটি আজ তার নয়। তবে কেন এত মায়া তার জন্য অর্পিতার?

মনে আজ ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ে ক্ষত-বিক্ষত অর্পিতা। সময় বড্ড নিষ্ঠুর। একদিন অর্পিতার কাছে যে সময় ছিল শুধুই ভালোবাসা তা আজ শুধুই মন্দ কথা। সে এর নাম দিয়েছে মন্দবাসা।
– See more at: http://www.risingbd.com/detailsnews.php?nssl=79716#sthash.nm71mWZo.dpuf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *