ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলের প্রধান জেইন ল্যাম্বার্ড বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন। নির্বাচনী বছরে দলীয় প্রধানের আটক হওয়ার ঘটনা বিএনপি’র জন্য অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। তবে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে মনোনিবেশ করা।
তিনি বলেন, আমরা জানি দল গোছানো এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সাথে আলাপকালে আমরা বিষয়টি উত্থাপন করেছি। ভবিষ্যতেও ইস্যুটির প্রতি আমাদের নজর থাকবে। কেননা কেবল নির্বাচনের দিনটিই নয়, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির দিনগুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কি না তা সে ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি উল্লেখ করে জেইন ল্যাম্বার্ড বলেন, বিগত জাতীয় নির্বাচন একতরফা হওয়ায় ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি। সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন সত্তা হিসাবে কাজ করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করবে – এটাই আমরা দেখতে চাই। তবে সার্বিকভাবে রাজনীতির জন্য এই মুহূর্ত চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে তিনদিনের সফর শেষে আজ বুধবার রাজধানীর ইইউ দূতাবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন।
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একদিকে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী বছরে কারাগারে অন্তরীণ, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। এই অবস্থাটি সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের জন্য কতটা অনুকূল।
১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলে আরো রয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব-কমিটির প্রধান পিয়ার অ্যান্তোনিও, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির উরমাস পেইট, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক ডেলিগেশনের মার্স তারাবিলা প্রতিনিধি দলের একটি অংশ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে মিয়ানমার গেছে। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার নেতাদের সাথে আলাপ এবং রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করবেন। অন্যদিকে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে জেইন ল্যাম্বার্ডের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে থেকে গেছে। এই প্রতিনিধি দলটি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ছাড়াও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও বাণিজ্য সচিবের সাথে বৈঠক করেছে। তারা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলের সাথেও মতবিনিময় করেছে।
জেইন ল্যাম্বার্ড বলেন, নাগরিক সমাজ আমাদের সাথে বৈঠকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খসড়া নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। এই অ্যাক্টের কারণে নাগরিক সমাজের পাশাপাশি মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার অবশ্য এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে আমাদের জানিয়েছে। এর বাইরে খসড়া বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্ট নিয়েও অনেকের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। নাগরিক সমাজ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের সমালোচনা করে থাকে। এ ইস্যুটির ব্যাপারে আমরা সচেতন রয়েছি। গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার গণতন্ত্রে থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি, সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নতুন কোনো প্রস্তাব আনা হবে কি না – প্রশ্ন করা হলে জেইন ল্যাম্বার্ড বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নতুন প্রস্তাব আনার সম্ভাবনা বেশি। চলতি মাসের শেষে ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠকে বসছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের জন্য ভবিষ্যত অর্থায়ন সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করার জন্য আমরা এর আগেই ইস্যুটি উত্থাপন করব। আর আগামী মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব অনুমোদনের চেষ্টা আমাদের থাকবে।
বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশ কতদিন সহ্য করতে পারবে – জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা খুব অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে রয়েছে। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির অবনতি হবে। তাদের মধ্যে ধর্মীয় চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এছাড়া তারা মানবপাচারেরও শিকার হতে পারে। এ জন্য তাদের মৌলিক শিক্ষার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি যাতে নিবদ্ধ থাকে, সেজন্য আমরা কাজ করে যাব। কেননা নাগরিক হিসাবে স্বীকার করে না – এমন মানুষদের আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে চাইবে না।