একটি অম্লমধুর সম্পর্কের ইতিহাস

Slider সারাবিশ্ব

39f00915eca95a89dd492f550d3a8346-5a56daa899062

 

 

 

 

 

 

সম্পর্কের আপাতত শেষ ধাপের শুরুটা হলো একটি টুইট বার্তা দিয়ে। নতুন বছরের প্রথম টুইট বার্তাতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন কথাটা-‘ওয়াশিংটনকে মিথ্যা ও ছলনা ছাড়া কিছুই দেয়নি পাকিস্তান। গত ১৫ বছরে ওয়াশিংটন বোকামি করে পাকিস্তানকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে।’

ট্রাম্পের ওই বার্তা আসলে ছিল পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সহায়তা বন্ধের আভাস। ওই আভাসের পরদিনই জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হ্যালি বললেন, পাকিস্তানকে ২৫ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অর্থসহায়তা দিচ্ছে না ওয়াশিংটন। এর দুদিন পরেই ৯০ কোটি ডলার সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এখানেই শেষ নয়-গত শুক্রবার মার্কিন এক কর্মকর্তা জানিয়ে দিলেন, আসলে ৯০ কোটি নয়, ২০০ কোটি ডলার সহায়তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

কেন সহায়তা বন্ধ
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, দেশটি সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ দমনেরে চেয়ে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ইসলামাবাদ।
সহায়তা বন্ধের ছোটখাটো ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তান যাতে নিজ ভূখণ্ডকে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ স্বর্গ হয়ে ওঠা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়-সে লক্ষ্যেই এই সামরিক সহায়তা বন্ধ করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের জবাব
ট্রাম্পের টুইট বার্তা ও এই সহায়তা বন্ধের জবাব দিতে সরব পাকিস্তানও। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেছে ইসলামাবাদ। তারা বলেছে, এটি ‘স্বেচ্ছাচারমূলক ও একতরফা সিদ্ধান্ত’। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হয়েছে ও হচ্ছে বলে দাবি পাকিস্তানের। বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ইসলামাবাদ বলেছে, গত ১৫ বছরে প্রধানত নিজস্ব সম্পদ দিয়েই তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান এই সময়ে এ কাজে ১২ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে।

বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে গত কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। যদিও দেশ দুটির সম্পর্কের এমন পর্যায় নতুন কোনো ঘটনা নয়। তাদের অম্লমধুর সম্পর্কের ইতিহাসটা বেশ পুরোনো। আফগানিস্তানে সর্বশেষ সন্ত্রাসবাদবিরোধী মার্কিন অভিযানের অন্যতম মিত্র হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে আপাতত শেষবারের মতো মধুর সম্পর্কে জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

সম্পর্কের সূচনা
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর নতুন দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম দেশগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে পাকিস্তানকে পাশে পেতে এটা করেছিল ওয়াশিংটন।

ভারতকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানকে কেন কাছে টানল যুক্তরাষ্ট্র? বলা যায়, নয়াদিল্লিকে না পেয়েই ইসলামাবাদমুখী হয় ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস বলছে, ১৯৪৯ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানকে বার্তা দেন-স্নায়ুযুদ্ধে কোনো পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকবে নয়াদিল্লি। আর এ বার্তাতেই মূলত ওয়াশিংটন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে যায়। বিপরীতে ভারত-রাশিয়া বন্ধুত্বের পথ সহজ হয়।

নেহরুর পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ওয়াশিংটন সফর করেন। তাঁর ওই সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন।

উত্থান-পতন
৫০-এর দশকে সোভিয়েতের ওপর নজর রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে পেশোয়ার বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেয় পাকিস্তান। অনুমতি দেয় মস্কোর ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে ওয়াশিংটনকে নিজের ভূখণ্ড ব্যবহারেরও। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে তাঁর প্রথম চীন সফরে মধ্যস্থতা করে ইসলামাবাদ। এর বিনিময়ে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে লাখ লাখ ডলার সামরিক সহায়তা পায় পাকিস্তান।

ওয়াশিংটন পোস্টের নিবন্ধে বলা হয়, আশির দশকে প্রথমবারের মতো দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা নেমে আসে। মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানকে দেওয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করে। ওয়াশিংটন বলে, পাকিস্তানকে দেওয়া সহায়তা দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে ব্যবহার করছে না-এটা নিশ্চিত করতে হবে। তা করতে না পারা পর্যন্ত সহায়তা স্থগিতই থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস পায় তখন, যখন মস্কোর বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছিল। আর ১৯৯২ সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকোলাস প্ল্যাট সরাসরি বলে বসলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।

তবে নাইন-ইলেভেনের পর দেশ দুটির সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। মস্কোর বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেমন পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র; এবার তেমনি সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে ইসলামাবাদকে কাছে টানে ওয়াশিংটন। পাকিস্তানের নেতারা ওই সময় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যাওয়া ছাড়া আসলে ইসলামাবাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, পাকিস্তানকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে না থাকলে পাকিস্তানে বোমা হামলা চালিয়ে ‘প্রস্তর যুগে ফেরত পাঠানো হবে’। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকার পুরস্কার অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবেই পেয়েছিল পাকিস্তান। দেশটির ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১০০ কোটি ডলার ঋণ মাফ করে দেয়। ২০০৪ সালের মধ্যে সামরিক জোট ন্যাটোর নতুন বন্ধু হিসেবে অস্ত্রও কেনার সুযোগ পায় ইসলামাবাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থেকে শুধু যে লাভ হয়েছে পাকিস্তানের, তা কিন্তু নয়। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি করেও। কারণ, আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় অনেক পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। নানাভাবে নিহত হয়েছে পাকিস্তানি সেনারাও। এরপর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে পাকিস্তানের বিষয়ে সুর বদলাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলতে থাকেন, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেটা কি সত্যিই ওই কাজে ব্যবহার করেছে?

এরপর বুশ ও ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি হতাশা ব্যক্ত করে। বলতে থাকে, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে দেশটি পর্যাপ্ত সহায়তা করেনি। এর ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা স্থগিত করে।

আর ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বুশ-ওবামার প্রশাসনের অবস্থানটা আরও কঠোর করলেন। সে আভাস অবশ্য তিনি গত আগস্টে দিয়েছিলেন, ‘পাকিস্তানকে যখন আমরা শত শত কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছি, তখন দেশটি সন্ত্রাসীদের জন্য বাসস্থান গড়েছে। আমরা আবার সেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।’

যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাসই বলছে, এটা সম্ভবত তাদের সম্পর্কের শেষ ধাপ নয়। প্রয়োজন হলে আবার নতুন মোড় নেবে এই সম্পর্ক। তবে কোন উদ্দেশ্যে বা কোন ঘটনাকে ঘিরে সম্পর্ক নতুন মাত্রা নেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *