এমপিওভুক্তির দাবি আদায় করতে গিয়ে রাজপথে পুলিশের আঘাতে প্রাণ গেছে শিক্ষক মোহাম্মদ সেকেন্দার আলীর। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে শিক্ষক- কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এ সময় শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত পিপার স্প্রে। এতে দুই শতাধিক শিক্ষক আক্রান্ত হন। পরদিন ১০ জানুয়ারি কর্মসূচির জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বসলে পুলিশ আচমকা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময়ও বিষাক্ত পিপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়। অনেকের সাথে গুরুতর আহত হন পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার চরবয়রা মডেল বালিকা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক মোহাম্মদ সেকেন্দার আলী (৪৫)। ১৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি। এ ছাড়া অনেক শিক্ষক দীর্ঘ দিন ধরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন।
এ দিকে গত এক দশক ধরে এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের বারবার মুখোমুখি হতে হয়েছে রাজপথে পুলিশি নির্যাতনের। অপর দিকে শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দ থেকে দেয়া আশ্বাস বাণী শেষ পর্যন্ত মিথ্যায় পরিণত হয়েছে শিক্ষকদের কাছে। তাই তারা এখন তাদের দাবি আদায়ে মরিয়া।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে। আমাদের হাতে কত ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হয়ে বড় বড় চাকরি করছে, বেতন পাচ্ছে কিন্তু আমাদের বেতন নেই।
আমাদের কষ্টের জীবন দেখে এলাকার মুদিদোকানিও কাঁদেন কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর চোখে পানি নেই। কথাগুলো বলছিলেন, সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সৈয়দা রাবেয়া বসরী।
জাতীয় প্রেস কাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকদের বক্তব্য- শিক্ষায় বিনিয়োগ হলো সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। অনেক খাতে অনেক বিনিয়োগ বৃথা যায়, সুফল পাওয়া যায় না, কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগ কখনো বৃথা যায় না। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের একটি পরিচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে শিক্ষকেরা তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা ডাল-ভাতের দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামেন বারবার। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাস করার পরও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হওয়ার কারণে সামান্য ভাতের দাবিতে রাজপথে দিনরাত পার করতে হয় অনশনরত অবস্থায়। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত শিক্ষকদের এ দুরবস্থা জাতির জন্য লজ্জার মনে করেন শিক্ষকেরা। তারা বলেন, আমাদের অসম্মান করা জাতিরই অসম্মান।
দীর্ঘ আন্দোলন ও আশাভঙ্গের আশ্বাস শিক্ষামন্ত্রীর
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে আমরণ অনশন করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এর নেতৃত্বে রয়েছে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন। এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকদের দীর্ঘ আন্দোলন পরিক্রমা এবং অসংখ্যবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আশ্বাস মিথ্যায় পরিণত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে গতকাল সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে।
ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে আমরা আন্দোলন করে আসছি। এ পর্যন্ত ২৬ বার কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। প্রতিবারই শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের কোনো-না-কোনো উচ্চপদস্থ নেতার আশ্বাসের পর আন্দোলন স্থগিত রাখা হয়েছে; কিন্তু প্রতিবারই এ আশ্বাস মিথ্যা আশায় পরিণত হয়েছে শিক্ষকদের কাছে।
২০০৫ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সারা দেশের সংসদ সদস্যদের অব্যাহত দাবিতে ২০১০ সালে এমপিওকরণের জন্য তালিকা সংগ্রহ করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরখাস্ত জমা হলেও এক হাজার ৬১০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে এমপিওভুক্ত করা হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ; কিন্তু ২০১০ সালের পর আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি।
শফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে বৈঠকে তিনি আমাদের আশ্বাস দেন দাবি পূরণে; কিন্তু পরে আর কোনো কাজ হয়নি। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে এই প্রেস কাবের সামনেই পদযাত্রাসহ লাগাতার আন্দোলন করা হয়। তাতে পুলিশের টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেটে আহত হন অনেকে।
আন্দোলন চলাকালে ৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয় দু-এক দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের সাথে বৈঠকে বসে বিষয়টি সুরাহা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শেখর ফেডারেশনের তখনকার সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তাপস কুমার কুণ্ডুর সাথে যোগাযোগ করেন। বিটিভিতে খবর প্রচার হয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে বসবেন। এরপর আন্দোলন স্থগিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী সচিব-১ মো: জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয় ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে সাক্ষাতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন (চিঠির কপি এ প্রতিবেদককে দেখান তিনি)। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এলেও পরে বৈঠক স্থগিত করা হয়।
২০১৩ সালে আবারো জাতীয় প্রেস কাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে বলে জানান শফিকুল। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট আর বিষাক্ত পিপার স্প্রের মুখোমুখি হয়ে আহত হতে হয়েছে শত শত শিক্ষককে। মারা যান একজন শিক্ষক। সেবার শিক্ষামন্ত্রী আমাদের কাছে তিন মাস সময় নিয়েছলেন দাবি পূরণের জন্য। কিন্তু হয়নি।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে প্রেস কাবের সামনে ২৮ দিন অনশন করেছিলাম। তখন প্রধানমন্ত্রীর প থেকে সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০১৬ সাল থেকে আমাদের এমপিওভুক্ত করা হবে।
২০১৬ সালে জাতীয় প্রেস কাব, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সামনে অনশন করেছি। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প থেকে দলটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও শিাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা আবারো আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তখন তারা বলেছিলেন, ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে আমাদের এমপিওভুক্ত করা হবে; কিন্তু করা হয়নি।
শফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আমরা বারবার বসেছি। তার বাসায়ও বৈঠক হয়েছে। প্রতিবার তিনি আমাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। পরে তিনি আমাদের এড়িয়ে যেতে শুরু করেন। তাই আর কোনো আশ্বাস নয়, এবার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া তারা ফিরবেন না।
ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় বলেন, ২০০৫ সালে সর্বশেষ এমপিওকরণ হয়েছে। এরপর আর হয়নি। এত দীর্ঘকাল কখনো এমপিও বন্ধ থাকেনি। তিনি বলেন, আমরা এরিয়া বেতন চাই না। যখন থেকে এমপিওকরণ হয় তখন থেকে বেতন দিলেই চলবে। তিনি বলেন, আমাদের হয়েছে ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলান অবস্থা। তিনি বলেন, আমার আর তিন বছরের মতো চাকরি আছে।
বিনয় ভূষণ রায় বলেন, তিনি জল্লা ইউনিয়ন আইডিয়াল কলেজে ২০০১ সাল থেকে অধ্যক্ষ পদে আছেন। বরিশাল বোর্ডে একাধিকবার এ কলেজ থেকে স্ট্যান্ড করেছে, জিপিএ ৫ চালুর পর টপটেনে স্থান পেয়েছে; কিন্তু তারপরও এমপিওভুক্ত হচ্ছে না তার কলেজ।
সারা দেশে পাঁচ হাজার ২৪২টি সরকারস্বীকৃত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ে। আরো কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে আংশিক এমপিওকরণ করা হয়নি। বিনয় ভূষণসহ অন্য শিক্ষকেরা বলেন, আমরা যোগ্য না হলে সরকার আমাদের প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিলো কেন?