স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঢাকা থেকে সড়কপথে রংপুর যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা। কিন্তু ভাঙাচোরা সড়ক ও সেতুর কারণে এ পথ পাড়ি দিতে এখন সময় লাগছে ১২-১৫ ঘণ্টা। ঈদের আগে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। তখন যাত্রার সময় ও ভোগান্তি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের পথে বগুড়ার মহাস্থান সেতুতে ফাটল, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চার লেন নির্মাণকাজের কারণে বেহাল অবস্থা, একমুখী যাতায়াত, খানাখন্দ ও যানজটে এবারের ঈদযাত্রা সীমাহীন ভোগান্তির হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন যাত্রী, চালক ও পরিবহন মালিকরা। দেশের অন্য সড়ক-মহাসড়কগুলোয়ও যানজটসহ দুর্ভোগ-ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে যথেষ্ট।
সরেজমিন গিয়ে ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-লালমনিরহাট-পাটগ্রাম মহাসড়কের বেহাল দৃশ্য চোখে পড়েছে। সড়কের কিছু দূর পর পরই খানাখন্দ। বড় বড় গর্তও তৈরি রয়েছে কোথাও কোথাও। কার্পেটিং উঠে বিভিন্ন স্থানে সড়কের কঙ্কালসার দশা বেরিয়ে এসেছে। এসব সড়কে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে।
পাটগ্রাম-ঢাকা রুটে এসআর পরিবহনের গাড়ি চালান সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘রাস্তা ভালো থাকলে পাটগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা। বর্তমানে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে।’
এ গাড়িচালক জানান, সড়কের পাটগ্রাম থেকে লালমনিরহাট অংশটি ভীষণ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বড় গর্তের সংখ্যা এতই বেশি যে, গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারের ওপর তোলা যায় না। লালমনিরহাট থেকে রংপুুরের শঠিবাড়ি পর্যন্ত অংশের অবস্থা কিছুটা ভালো। এরপর সড়কের আর ভালো জায়গা বলতে কিছু নেই। বগুড়ার মহাস্থান সেতু পার হতেই সময় লাগছে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঈদের সময় পাটগ্রাম-ঢাকা রুটে গাড়িতে গন্তব্যে পৌঁছতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে যানজটের অন্যতম কারণ বগুড়ার মহাস্থান সেতু। সরেজমিন মহাস্থান সেতু ঘুরে দেখা যায়, তিনটি স্প্যানের ওপর দাঁড়ানো সেতুটির মূল কাঠামোর মাঝের অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেতুর ওপর ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য স্টিলের কাঠামোর আরেকটি অপ্রশস্ত সেতু বানানো হয়েছে। এ কাঠামোর দুই পাশে বালির বস্তা ফেলে প্রায় তিন ফুট উঁচু স্তর বানানো হয়েছে। দুই প্রান্তের দুই স্তরের সঙ্গে স্টিলের কাঠামোটি বসানো। ফলে সেতুটিতে যখন কোনো ভারী যানবাহন ওঠে, তখন সেই যানবাহনের ভর মাঝ বরাবর না পড়ে দুই পাশে ছড়িয়ে যায়।
সেতুটি এমনিতেই বেশ অপ্রশস্ত। এর ওপর যে স্টিলের কাঠামোটি বানানো হয়েছে তা আরো অপ্রশস্ত হয়ে গেছে। প্রতি ১০-১৫ মিনিট পরপর এক প্রান্ত বন্ধ রেখে আরেক প্রান্তের গাড়ি যেতে দেয়া হচ্ছে। এর প্রভাবে সেতুটির দুই পাশে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সেতুটি পার হওয়ার জন্য একটি গাড়িকে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে রাস্তায়।
সেতুটির বিষয়ে বগুড়া সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, এটি খুব সম্ভবত ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে বানানো, যদিও সেতুর ইতিহাস সম্পর্কিত কোনো নথি আমাদের হাতে নেই। ফাটল দেখা দেয়ার পর ঢাকা থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে সেতুটি পর্যবেক্ষণ করেছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ীই ওপরের স্টিলের কাঠামো বানানো হয়েছে।’
শুধু মহাস্থান সেতুতে নয়, ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ও ঢাকা-লালমনিরহাট-পাটগ্রাম মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে বগুড়ার মোকামতলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, রংপুরের শঠিবাড়িসহ বিভিন্ন অংশে ভাঙাচোরা ও খানাখন্দের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে বগুড়ার মোকামতলা বাজার, গোবিন্দগঞ্জ বাজারের কাছের অংশটির অবস্থা ভীষণ করুণ।
এদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান থাকায় যানবাহন চলাচল করছে ধীরগতিতে। সিরাজগঞ্জের কাঠেরপুল এলাকার বাসিন্দা রমজান আলী সড়কটি সম্পর্কে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ যেতে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু সড়কটিতে সংস্কারকাজ চলায় গত পরশু (বৃহস্পতিবার) সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতে আমার ৮ ঘণ্টা সময় লেগেছে।’
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। গাড়ি চলাচল করছে ধীরগতিতে। বৃষ্টি হলে সড়কটির অবস্থা আরো করুণ হয়ে ওঠে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় গাড়ি চলাচল করছে একমুখীভাবে। এ কারণে ওই স্থানে যানজট তৈরি হচ্ছে। যাত্রী ও চালকরা জানিয়েছেন, এ অংশটুকু পার হতে ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে।
শুধু রাজধানীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের নয়, ঈদযাত্রায় দেশের সব মহাসড়কে যানজট ও দুর্ভোগের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ সম্পর্কে ট্রাফিক পুলিশ দক্ষিণ জোনের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঈদের সময় মহাসড়কগুলোয় যানবাহনের চাপ বেশ বেড়ে যায়। প্রতি ঈদের মতো এবারো আমরা সড়কগুলোয় যানজট ও বিশৃঙ্খলা নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে ঈদযাত্রায় সড়কে যেহেতু প্রচুর যানবাহনের চাপ থাকে, সেহেতু যাত্রীদের একটু ধৈর্যশীল হতেই হবে।’
অন্যদিকে পরিবহন মালিকরা বলছেন, ভাঙাচোরা সড়কের কারণে একদিকে যেমন দীর্ঘ যানজট তৈরির শঙ্কা রয়েছে, তেমনি গাড়িগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার বলেন, ‘ভাঙাচোরা সড়কের কারণে এবারের ঈদযাত্রায় যাত্রীদের বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে। পাশাপাশি এসব সড়ক দিয়ে যেসব যানবাহন চলাচল করছে, সেগুলোর আয়ুষ্কালও কমতে শুরু করেছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঈদযাত্রায় সড়কগুলো ভোগান্তিমুক্ত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভাঙাচোরা স্থানগুলোয় সংস্কারকাজ চলছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে দু-একদিনের মধ্যেই আমরা সংস্কার করতে পারব।
বগুড়ার মহাস্থান সেতু সম্পর্কে তিনি বলেন, সেতুটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় আমরা প্রাথমিকভাবে সেটি যান চলাচল উপযোগী করেছি। নতুন সেতু বা বেইলি ব্রিজ বানানো ছাড়া এর কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। ঈদের আগে মহাস্থান সেতুটি এর চেয়ে ভালো অবস্থানে নেয়া সম্ভব নয়।
বন্যায় দেশের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো সম্পর্কে এমএএন সিদ্দিক বলেন, ‘বন্যার কারণে আমাদের বেশকিছু সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর বেশ কয়েকটিতে এরই মধ্যে সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। যেগুলো বাকি রয়েছে, সেগুলোতেও দ্রুত সংস্কারকাজ শুরু হবে। আশা করছি, গত ঈদের মতো এবারো মানুষ কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই যাতায়াত করতে পারবে।’