ঢাকা ; বনানীতে হোটেলে আটকে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন। গতকাল রবিবার বিকেলে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসানের আদালতের খাসকামরায় সে জবানবন্দি দিয়েছে। এ ছাড়া এ মামলায় সাফাত ও সাদমান সাকিফের কাছ থেকে জব্দ করা পাঁচটি মোবাইল ফোনসেট ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছেন আদালত। মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতিও দিয়েছেন আদালত।
মামলা নিতে দেরি করা, ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া ও ভুক্তভোগী দুই তরুণীকে হয়রানির অভিযোগে গতকাল বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নির্দেশে তদন্ত সহায়ক চার সদস্যের কমিটি বিকেল ৩টা থেকে এক ঘণ্টা ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সূত্র জানিয়েছে, কোনো প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পারেননি ফরমান আলী।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিল্লাল জবানবন্দিতে বলেছে, ‘দুই শিক্ষার্থীকে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের অষ্টম তলার দুই রুমে আটকে রেখে সাফাত ও নাঈম ধর্ষণ করে। দুই তরুণীর ধর্ষণের পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে সাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ। তাদের মধ্যে নাঈম ধর্ষণকাজে প্রধান ভূমিকা রাখে। ধর্ষণের সময় দুই তরুণীই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিত্কার করে। এমন কাজে বাধ্য না করতে তারা সাফাত ও নাঈমের হাত-পা ধরে। কিন্তু তারা (সাফাত-নাঈম) কিছুতেই ছাড় দেয়নি। সাফাতের কথামতো আজাদ ও আমি (বিল্লাল) পুরো রাতই হোটেলের ওই কক্ষ পাহারা দিই। খাবারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম এনে দিই। ধর্ষণের সময় দুই শিক্ষার্থীর দুই বন্ধুও ছিল। তাদের মধ্যে একজনকে গভীর রাতে সাফাত তার রুমে আসতে বলে। এরপর তাকে বাথরুমে দাঁড় করিয়ে রাখে সাফাত। ওই সময় এক রুমে সাফাত, অন্য রুমে নাঈম ও সাদমান দুই তরুণীকে ধর্ষণ করে। এরপর পাশের রুম থেকে দুই তরুণীর ওই বন্ধুকে ডেকে এনের তাকে মারধর করা হয়। তাদের কথা না শোনায় তাকে ইয়াবা দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ধর্ষণের সময়ও আমি দুই বাথরুমে দাঁড়িয়ে ঘটনার ভিডিও ধারণ করি। ’
জবানবন্দি শেষে বিল্লালকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। আদালত সূত্র জানায়, এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যামি ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য আদালতে আবেদন জানান। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসানের খাসকামরায় বিল্লাল জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দি দেওয়ার আগে তাকে চিন্তাভাবনা করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়। জবানবন্দি দেওয়ার সময় সে পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল।
গত ১৫ মে পুরান ঢাকার নবাবপুরের একটি আবাসিক হোটেল থেকে বিল্লালকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই দিন রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সাফাতের দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ ওরফে রহমতকে।
এর আগে গত ১৮ মে সাফাত ও সাদমান ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। রিমান্ড শেষে দুজনই বর্তমানে কারাগারে। আজাদকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নাঈমকে গত বুধবার রাতে মুন্সীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরের দিন আদালতের মাধ্যমে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
নাঈমের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, নাঈমসহ সব আসামি রিমান্ডে ধর্ষণের দায় স্বীকার করেছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।
মোবাইল ফোন সিআইডিতে : সাফাত ও সাদমানের কাছ থেকে জব্দ করা পাঁচটি মোবাইল ফোনসেট ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কাছে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মহানগর হাকিম দেলোয়ার হোসেন এ আদেশ দেন। এ ছাড়া এ মামলার অন্যতম আসামি নাঈমের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতিও দিয়েছেন আদালত। গতকাল একই আদালত সিআইডির ফরেনসিক বিভাগকে এ আদেশ দেন।
তদন্তে পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে, আরো সময় নিল কমিটি : তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মামলা নিতে গাফিলতিসহ ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীকে হয়রানি ও মামলার পর আসামিদের গ্রেপ্তারে গড়িমসির অভিযোগে ওসি ফরমান আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বনানী থানার পুলিশের দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ এরই মধ্যে পেয়েছে পুলিশের গঠন করা তদন্ত কমিটি। গতকাল ডিএমপি কমিশনারের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে তদন্তের কাজ শেষ করতে না পারায় কমিটি আরো তিন দিন সময় নিয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এ কারণে আরো তিন কার্যদিবস সময় নেওয়া হয়েছে। তবে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে কিছু অনিয়ম ও অসংগতি তাদের নজরে এসেছে। এসব অনিয়ম ও অসংগতির সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকুক না কেন, তার শাস্তির সুপারিশ করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে বেশির ভাগ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। যদিও ওসি ফরমান আলী বরাবরই এ ঘটনায় তাঁর দায় অস্বীকার করে আসছেন। তিনি মামলা নিতে বিলম্বের দায় ডিএমপির গুলশান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। তবে তদন্তে অন্য কারো বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে ওসির বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছেন।
জানতে চাইলে গতকাল ডিএমপিতে যাওয়ার কথা স্বীকার করে ওসি ফরমান আলী বলেন, অফিশিয়াল কাজে ডিএমপিতে গিয়েছিলেন। এর বাইরে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চাননি।