মোঃ নাজমুল ইসলাম (মিলন): দিনাজপুর প্রতিনিধি- দিনাজপুরের বীরগঞ্জের জমিলা জীবনযুদ্ধে নারী কসাই এর ব্যবস্যা করে নারী উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে স্বাবলম্বী ও প্রতিষ্ঠিত করায় জেলা ও উপজেলা হতে ”জয়িতা”পদক প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের একমাত্র মহিলা কসাই জমিলা সরকারের সহযোগিতা পেলে গরুর খামার দিয়ে সমাজের অবহেলিত ও অস্বচ্ছল নারীদেরকেও প্রতিষ্ঠিত করার কাজে পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন জমিলা কসাই।
উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের ঝাড়বাড়ীতে প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে পুরুষের সাথে সমান তালে লড়াই করে নানা বাঁধা পেরিয়ে পান ব্যবসায়ী মৃত জাকির হোসেনের কন্যা জামিলা বেগম অরফে জমিলা (৪৯) নারী কসাইয়ের কাজ করে একজন সফল নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। বাড়ীতে গড়ে তুলেছেন ১০/১২টি গরুর ছোট একটি খামার। ১০/১২ জন লোক কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন তার কারনেই।
সরজমিনে গেলে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর এলাকার জাকির হোসেন বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ী এলাকায় এসে পানের ব্যবসা শুরু করেন। জাকির হোসেনের চার মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে জমিলা তৃতীয়। স্কুলে যাওয়া ও পড়া হয়নি জমিলার। ১৪ বছর বয়সে জমিলার বাবা বগুড়ার মহস্থানগড় এলাক গোকুলের উত্তর পাড়ার ছ’মিল বন্দর এলাকার রফিকুল ইসলাম ভান্ডারী নামে এক কসাই সঙ্গে স্বতিনের ঘরে বিয়ে দেন মেয়েকে। প্রথম সন্তান জহুরুলের জন্মের কিছুদিন পর স্বামী কসাই রফিকুল ইসলাম ভান্ডারী নেশা ও নারীর আসক্তে ব্যবসা নষ্ট করে ফেলে। ১৯৯৭ সালের দিকে রফিকুল ও জমিলা বগুড়া হতে ঝাড়বাড়ী এলাকায় চলে এসে বাবার সামান্য জমি বিক্রি করে বাজারে একটি মাংসের দোকান শুরু করেন। সে সময় দোকানে স্বামীকে সময় দিতেন জমিলা। পরিবারেও ফিরে আসে শান্তি। ছেলে জহুরুল তখন নবম শ্রেনীর ছাত্র। ব্যবস্যা চলা কালে কসাই রফিকুল ভান্ডারী বিভিন্ন জনের কাছে ২ লাক্ষ ৮২ হাজার টাকা ধারদেনা করে নিখোঁজ হয়ে যায়।
স্বামী কসাই রফিকুল ভান্ডারী চলে যাওয়ার পর পাওনাদারদের চাপের মুখে ও সংসারের তাগীদে জমিলা স্বামীর সঙ্গে থেকে থেকে কসাইয়ের কাজ দেখা প্রশিক্ষনকে কাজে লাগিয়ে ২০০০ সালে ছেলে জহুরুলকে সাথে নিয়ে পুনরায় ‘মায়ের দোয়া মাংস ভা-ার’ নাম দিয়ে নিজেকে মহিলা বা নারী কসাইয়ে রুপান্তরিত করে। নিজে হাটে গিয়ে দেখে শুনে গরু কেনেন। ”সততাই ব্যবসার মুলধন” পতিপাদ্য নিয়ে মাংসের ব্যবস্যা শুরু করে মা ছেলে আস্তে আস্তে কসাই রফিকুল ভান্ডারীর ধারদেনা করে নিয়ে যাওয়া টাকা পরিশোধ করে। বাবার বাড়ীর পাশে ১১ শতক জমি কিনে বাড়ী বানায় ও ছোট পরিসরে একটি গরুর খামার তৈরী করেন। বাড়ীর সামনে একটি মুদিখানার দোকানো করেন। মাংস বিক্রয় শেষ হলে মুদির দোকানে বাঁকি সময়টা কাটান। জমিলা এক ছেলে, ছেলের বউ, দুই নাতি আর মেয়ে সোহাগীকে নিয়ে অনেক সুখে আছে।
কসাই জমিলা বলেন, বাজারে আরও ৪/৫ জন মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর যখন দোকান শুরু করি তখন অনেকেই বিরোধিতা করে থানায় ও ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এলাকার কিছু লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে উৎসাহ ও সাহস দেয়। সে সময় তাকে আশ্রয় দিয়ে বিয়ে করেন শতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্য আব্দুস সালাম। জমিলার দোকানের মাংসের ক্রেতা দিনাজপুর জেলাসহ পাশের নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় জেলার মানুষও। বিয়ে বাড়ি, আকিকা, খতনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জমিলার দোকানের মাংস আশে পাশের গ্রাম শহরের যায়। জমিলা প্রতিদিন তিন-চারটি, শুক্রবারে আট-দশটি গরুর নিজ হাতে কেটে মাংশ বিক্রি করেন। বর্তমানে তার দোকানে ১০/১২ জন লোক কাজ করে।
জমিলা আরো জানায়, নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ”জয়িতা পদক” পুরুস্কার পেলেও অদ্যাবধী সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা পায় নাই। যদি সে সরকারি সহযোগিতা পায় তবে বড় ধরনের একটি গরুর ফার্ম দিয়ে সমাজের অবহেলিত ও অস্বচ্ছল নারীদেরকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। তবে নবম শ্রেণির ছাত্রী মেয়ে সোহাগী আক্তার’কে উচ্চ শিক্ষিত করে সরকারী চাকুরি করাতে চাই। যতদিন বাঁচি কসাইয়ের ব্যবসা চালিয়ে যাব।
ছেলে জহুরুল জানায়, পারিবারিক সমস্যা থাকায় ছোট থেকে ব্যবসায় মায়ের পাশে দাড়ানোর কারনে তার পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। তবে মাকে নিয়ে তার অনেক শ্রদ্ধা ও গর্ভ রয়েছে। মায়ের কারনে সে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্যায়ী।গত করোনা কালে বা এ পযন্ত তার গরুর খামার বা তারা সরকারী সহযোগিতা মেলেনি। ২২ বছরে ক্রেতাদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বস্ত। ‘জমিলা কসাই’ এখন এক নামেই পরিচিত।
মেয়ে সোহাগী আক্তার জানায়, সে ঝাড়বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুলে যাওয়ার শুরুতে অনেকেই বলত তোর মা কসাই, তার সাথে মিশতে চাইত না অনেকে। তবে ভালো ছাত্রী হয়ে সে সমস্যার সমাধান করেছে। ভবিস্যতে সে ডাক্তার হতে চায়।
মাংস ক্রেতা ঠাকুরগাঁও জেলার গড়েয়া এলাকায় আবু জাহেদ টিটুল জানায়, তার দোকানের মুল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হাঁড় ছাড়া মাংস। আমরা দার্ঘী দিন ধরে তার কাছেই গরুর মাংস নিতে আসি। ঝাড়বাড়ী দ্বিমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা জানায়, জমিলা কসাই অত্যান্ত পরিশ্রমী ও সৎ। তার মেয়ে আমার বিদ্যালয়ের ভালো ছাত্রী। তারা সরকারী সহযোগিতা পেলে অনেক ভালো করবে জনগনের জন্যও।
শতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য স্বামী আব্দুস সালাম জানায়, জমিলা কসাই ঝাড়বাড়ী বাজারে মাংস বিক্রি করেন। কিন্তু তার সুনাম পার্শবর্তী কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দূর-দূরান্তের মানুষ মাংস ক্রয় করে নিয়ে যায়। ওজন, দাম ও গুনগত মান বজায় রেখেই তিনি মাংস বিক্রি করেন বলে এলাকায় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। সে পরিশ্রমী ও পর উপকারী। জমিলা নারী উদ্যোক্তা হিসাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কারনে সারাদেশে আলোচিত হওয়ায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরুস্কার ”জয়িতা”পদক পায়। তবে সরকারী ভাবে সে কোন সহযোগিতা পায় নাই। সরকারী সহযোগিতা পেলে সে এলাকার মানুষের অনেক উপকার করতে পারবে বলে আমি মনে করি।