পালিয়ে আসা হিন্দুরা কেমন আছে?

Slider চট্টগ্রাম

দুপুরের সূর্যের তেজটা কমতে শুরু করেছে সবে। তখন পৌঁছালাম পশ্চিম হিন্দুপাড়ায়। অবস্থান কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির থেকে দুই কিলোমিটার দূরে।

ইট বিছানো পথে পা রেখেই ডান দিকে চোখে পড়ল ‘আলোচিত’ মুরগির খামার। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পুলিশের অনেকগুলো তল্লাশিচৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। একপর্যায়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ চলে আসে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের চার শতাধিক মানুষ।

সরু সড়কজুড়ে শিশুদের কলরব। নিজেদের মতো খেলছে, হাসছে। সমবয়সীদের সঙ্গে পেরে না উঠলে মারামারি করছে, আবার মিলও হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের এই দুরন্তপনা দেখতে দেখতে চোখে পড়ল আশপাশের বাড়িগুলোর দিকে।

মাটির ঘর, টিনের চাল। সামনের উঠান ঘিরে গাছগাছালি। ওই গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে পলিথিন দিয়ে বানানো ঝুপড়িঘর। কৌতূহল হলো। উঁকি দিয়ে কথা বলতে চাইলাম। বের হয়ে এলেন এক যুবক, নাম সুমন্ত রুদ্র।

97414b70cddb61b1af8b0dbb4dc52025-5a1f749ff04b5

 

 

 

 

সুমন্তের ভাষ্য, রাখাইনের মংডুতে ফকিরাহাট, চিকনছড়িসহ কয়েকটি গ্রামে হিন্দু পরিবারের বাস। গ্রামগুলো স্থানীয় থানা থেকে দূরে। ২৫ আগস্ট থানাতে হামলার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে মুখোশে ঢাকা কালো পোশাকধারীরা। পাঁচ দিন ওই অবস্থায় ছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা। এ সময় বহু লোককে গলা কেটে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে কালো পোশাকধারীদের সঙ্গে অন্যদের লড়াই শুরু হলে তাঁরা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

৬ নভেম্বর কথোপকথন চলার সময় আশপাশে ভিড় জমালেন আরও কয়েকজন নারী, পুরুষ ও যুবক। জানালেন, জীবন বাঁচাতে কতটা কষ্ট করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন। এখানে কী অবস্থা? জানতে চাইলে বললেন, এটা এখনো অস্থায়ী ক্যাম্প। এখানে ত্রাণ তৎপরতা কম। এখানে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনবার ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে ডাল, লবণ, তেল। স্থায়ী ক্যাম্প হলে হয়তো আরেকটু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত। তবে স্থানীয় লোকজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তাঁরা। বললেন, এখানকার কয়েকটি পরিবারের উদারতায় তাঁরা ঝুপড়িঘর করে থাকতে পারছেন। এখন আর সবাইকে গাদাগাদি করে মুরগির খামারে থাকতে হচ্ছে না।

fa96a7dbeb09923a7089a12754296517-5a1f749fd725f

 

 

 

 

একটু এগোতেই পাশে দাঁড়ালেন এক মধ্যবয়সী নারী। বিধবা, তবে সিঁথির সিঁদুর যে খুব বেশি দিন আগে মোছেনি, সেটা স্পষ্ট। নাম বকুল বালা। বললেন, মেয়েকে নাইয়র আনতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন স্বামী। সেখানে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে জানতে পারেন স্বামী, মেয়ে, নাতিসহ বেয়াইবাড়ির সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর প্রাণ বাঁচাতে দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এখানে আসেন। তাঁর চোখ দিয়ে গড়াতে থাকল পানি। আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে যা বললেন, তার অর্থ দাঁড়াল—‘আমার মেয়েটা তোমার মতো ছিল!’

বকুল বালা যখন হারানো মেয়ের কথা মনে করে কাঁদছিলেন, তখন নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা জ্ঞান বালা। সাত মাস চলছে তাঁর। বললেন, শরীরের এ অবস্থা নিয়ে তিনি চিন্তায় আছেন। নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে সন্তানের জন্ম দিতে পারলে ভালো হতো। নিজেই অসহায় অবস্থায় আছেন, অনাগত সন্তানের কী হবে—ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

e2c3357cb28e03ff4f3758f07b969491-5a1f74a026954

 

 

 

 

তবে জ্ঞান বালাকে সান্ত্বনা দিলেন আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন নারী। বললেন, থাকতে যখন দিয়েছে, বিপদেও নিশ্চয় পাশে দাঁড়াবে। চিন্তা করার দরকার নেই। যাদের কারণে পালিয়ে আসা, এই মানুষদের মনে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের একজন অনিমা বড়ুয়া। তাঁর বাড়ির আশপাশে ছয়টি ঝুপড়িঘর। জানালেন, পালিয়ে আসা ব্যক্তিরা নিজ উদ্যোগে এগুলো বানিয়েছে। মানবতার খাতিরে তিনি তাঁদের থাকতে দিয়েছেন।

মানবতার জয় দেখে মনটা ভালো হয়। ফেরার জন্য সড়কে উঠতেই আবার শিশুদের কলকাকলি। তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই দেখা ক্যাম্প স্বেচ্ছাসেবক সোহেল বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, এখান থেকে পরিবারগুলোকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে।

1bc6bd36d845cf29d5197864cab82760-5a1f74a02db0e

 

 

 

 

গাড়িতে ওঠার আগমুহূর্তে একদল শিশু ঘিরে ধরল। দাবি, তাদের ছবি তুলতে হবে। ছবি তোলাও হলো। এবার তাদের দাবি, ছবিটা কেমন হলো সেটা দেখাতে হবে। ছবি দেখানোর পর একেকজনের হাসিমুখ এখনো চোখে ভাসে।

এই পরিবারগুলোকে নিয়ে প্রশাসনের ভাবনা কী—জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান বলেন, এই পরিবারগুলোকে এখান থেকে ১৫০ মিটার দূরে একটি স্থানে নিয়ে পুনর্বাসন করা হবে। এ কাজে পাশে থাকছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *