মিয়ানমারের বুছিদং থানার নাইরের খোয়া গ্রাম থেকে হেঁটে আট দিন পর শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেন হোসনে আরা। সঙ্গে স্বামী-চার সন্তানসহ কাফেলায় ছিল প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এ আশায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন নিজ পাড়াতেই। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন এপারে চলে আসার। ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে যখন যাত্রা শুরু করলেন, হোসনে আরার কোলে তখন মাত্র ছয় দিনের নবজাতক। চেষ্টা সত্ত্বেও নবজাতকটিকে কোনোভাবেই বাঁচাতে পারলেন না মা হোসনে আরা। কারণ ভূমিষ্ঠের পর নবজাতকের যে সেবা বা চিকিৎসার প্রয়োজন, তার কিছুই দিতে পারেননি মা হয়ে। যাত্রার দুই দিন পরই সন্তানটি মারা যায়। বুছিদংয়ের এক অচেনা পাহাড়ে নাড়িছেঁড়া ধনকে যখন দাফন করা হচ্ছিল, তখন পর্যন্ত নবজাতকের কোনো নামই রাখা হয়নি। কান্না আর শোক ভুলে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে শিশুটির দাফন শেষে আবারও যাত্রা শুরু হয়। পথিমধ্যে মিয়ানমারের মগ ও চাকমাদের হাতে দুই দফা লুটপাটের শিকার হন তারা। দেশান্তরি হওয়ার পথেও রক্ষা মেলেনি তার। অস্ত্রের মুখে হোসনে আরার কাছ থেকে টাকা-পয়সা, গয়নাগাটিসহ সর্বস্ব লুটে নেয় বর্বর মগরা। প্রতিবাদ করলে আরও বিপদ হবে এই ভয়ে সব হারিয়ে আবারও রওনা দেন বাংলাদেশের পথে। এ ঘটনা শুধু একজন হোসনে আরারই নয়, ওই কাফেলায় থাকা হাজারো নারীর। পুরুষদেরও নানাভাবে নির্যাতন করে হাতে যা ছিল সব ছিনিয়ে নেয় মিয়ানমারের ওই সব নিষ্ঠুর বৌদ্ধরা। গতকাল দুপুরে হোসনে আরার সঙ্গে কথা হয় উখিয়ার পালংখালী টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের একপাশে। ছোট্ট একটি পাহাড়ি টিলায় তার সঙ্গে সহযাত্রী ছিল আরও অন্তত তিন শতাধিক রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ ইউছুফ, ফাতেমা বেগম, নূর কবির ও ইমান হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের প্রত্যেকের কাছে এ রকম বাস্তবনির্ভর নির্মম সত্য গল্প শোনা হয়। তারা জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্যাতন থামেনি। আরাকান রাজ্যে এখনো নতুন করে প্রতিদিন মুসলিম পাড়াগুলোতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলেও থাকা যাচ্ছে না। ছয় থেকে আট দিন পায়ে হেঁটে তারা শুক্রবার সন্ধ্যা ও গতকাল ভোরে পালংখালীর উনছিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কথা হয় রোহিঙ্গা নূর কবিরের (৪৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসার পথে আমাদের সঙ্গে থাকা এক শিশুসহ তিনজন অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। মগ-চাকমারা লুটপাট চালিয়েছে দুইবার। এখানে আসার পর এখনো কোনো খাবার জোটেনি। থাকার জায়গা কোথায় মিলবে সেটাও অনিশ্চিত। তবে প্রাণে বেঁচে আছি এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। ’ একই স্থানে কথা হয় রোহিঙ্গাদের এক মাঝি (দলনেতা) মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশে এসেছেন প্রায় এক মাস। নতুন করে আসা তার স্বজাতি রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বলেন, ‘দু-এক দিন একটু কষ্ট করতে হবে। আশপাশের কোনো পাহাড়ে তাদের থাকার জায়গা হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কয়েকজন লোক এসে তাদের ত্রাণকার্ড দিয়ে গেছে। হয়তো আজকের মধ্যেই কিছু ত্রাণ তারা পেয়ে যাবে। ’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকালও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের অনেকে রাস্তার পাশে ও বেসরকারি বিভিন্ন পাহাড়ি টিলায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। তাদের কারও হাতে কোনো নগদ অর্থকড়ি নেই, খাবারদাবারও ছিল না। দীর্ঘ পথ হেঁটে অনেকেই ছিলেন অসুস্থ ও অভুক্ত। সবারই পা ফুলে গেছে। কারও কারও পায়ে ক্ষতচিহ্নও দেখা গেছে। মলিন চেহারায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের। আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে আরও ১৫ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ অপেক্ষা করছে। সীমান্তে এসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে কেউ কেউ মারধরের শিকারও হয়েছেন। কেউ গুলি খেয়ে মারাও গেছেন। নারী, শিশু ও বৃদ্ধারা সেনাবাহিনীসহ দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে নানা কৌশল নিয়েছেন। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, কোথাও কোথাও হামাগুড়ি দিয়েও নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে তাদের।