আন্তর্জাতিক চাপকে তোয়াক্কা না করে সীমান্তে আবারও কঠোর অবস্থানে মিয়ানমার। নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি কোথাও কোথাও তারে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ।
রাতের আঁধারে সীমান্তজুড়েই পুঁতে রাখা হচ্ছে স্থলমাইন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ থেকে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীযেন মিয়ানমারে পুশইন করতে না পারে। এখনো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় প্রতিদিনই সকালে-বিকালে দেওয়া হচ্ছে আগুন। কখনো কখনো আগুনের তীব্রতা বাড়াতে হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছে দাহ্য পদার্থ। গতকাল উখিয়ার পালংখালী, বান্দরবানের ঘুমধুম, জলপাইতলী, তুমব্রুসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকা সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বেলা ১১টায় ঘুমধুমে বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওই পারে মিয়ানমারের সীমান্তজুড়েই সেনাবাহিনী ও বিজিপি অবস্থান নিয়েছে। সেখানে কোনো কোনো স্থানে কাঁটাতারের বেড়া পুনর্নির্মাণ করছে তারা। একই চিত্র দেখা গেছে জলপাইতলীতেও। সেখানেও নতুন কাঁটাতারের বেড়া লক্ষ্য করা যায়। দুপুর ১২টার দিকে তুমব্রু সীমান্তে দেখা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপির উপস্থিতিতে সাত-আটজন শ্রমিক সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছেন। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকায় সীমান্তজুড়েই অবস্থান নেয়। বিজিপিকেও শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়। পাশেই পজিশন নিয়ে অবস্থান করছিল মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। এপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) ছিল সতর্কাবস্থায়। প্রায় দুই ঘণ্টা তুমব্রু সীমান্তে দেখা যায় মিয়ানমার বাহিনীকে। এদিকে বিকালে পালংখালীর সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। তুমব্রু সীমান্তে স্থানীয়রা জানান, চার দিন ধরেই মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি সীমান্তে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও সীমান্ত পিলার বসিয়ে রোহিঙ্গা ও অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোই তাদের উদ্দেশ্য। মিয়ানমার সীমান্তে এসব কাজে সেনাবাহিনী ও বিজিপিকে দৃশ্যমান দেখা গেছে। নির্মাণসামগ্রী বহনের যানবাহনও দেখা যায়। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কোনো রোহিঙ্গা যেন দেশটিতে ফিরে যেতে না পারে সেজন্যই সতর্কাবস্থায় তারা। এজন্যই নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঁটাতারের বেড়া এবং ভেঙে যাওয়া পিলার পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। জানা গেছে, উখিয়া থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা, আশারতলী, বড় ছনখোলা, ফুলতলী, লেবুছড়িসহ সীমান্তজুড়েই পুঁতে রাখা হচ্ছে স্থলমাইন। এরই মধ্যে কয়েকটি স্থানে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অন্তত ১০ জন রোহিঙ্গা ও বাঙালি মারা গেছে। সীমান্তের কাঁটাতার ও নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের মাঝামাঝি এসব স্থলমাইন পুঁতে রাখা হচ্ছে। যেগুলো বিকল বা বিস্ফোরিত হয়ে যায়, সেগুলোর জায়গায় আবারও নতুন করে মাইন পুঁতে রাখা হচ্ছে। সম্প্রতি তুমব্রু সীমান্তে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের কাছাকাছি এলাকা থেকে কয়েকটি তাজা মাইন তুলে নিয়ে আসে কয়েকজন রোহিঙ্গা কিশোর। তারা জানায়, নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের কাছাকাছি একটি পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে একজন রোহিঙ্গা পুরুষ ও একটি গরু মারা যায়। এ নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করে। একপর্যায়ে কয়েকজন কিশোর রোহিঙ্গা ওই এলাকায় পুঁতে রাখা কয়েকটি স্থলমাইন তুলে নিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। নাইক্ষ্যংছড়ির বড় ছনখোলায়ও সম্প্রতি হানিফ নামে এক বাঙালি নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে গিয়ে মিয়ানমার বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। বান্দরবানের আশারতলী ক্যাম্পে থাকা শামসুল ইসলাম জানান, ওই এলাকায় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়, যাতে ভয়ে কোনো রোহিঙ্গা তাদের মিয়ানমারে ফেলে আসা বসতবাড়িতে আর ফিরে যেতে না পারে। তিনি জানান, সীমান্তের ওই পারে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুটিকয় রোহিঙ্গাও ভয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারছে না। এদিকে গতকাল বিকালেও পালংখালীর সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গাপাড়াগুলোয় নতুন করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে দাহ্য পদার্থও ফেলা হয়। এপারে বিজিবি ক্যাম্প থেকে তা স্পষ্ট দেখা যায়। এর আগেও ওই পাড়াগুলোয় কয়েক দফা আগুন জ্বলতে দেখা যায়। রোহিঙ্গাশূন্য এসব পাড়ায় দফায় দফায় আগুন দিয়ে আরও ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। একইভাবে শাহপরীর দ্বীপের বিপরীতে নাইক্ক্যানদিয়া, শিকদারপাড়া, উকিলপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামেও কয়েক দিন ধরে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। ওই এলাকার গাছপালা, এমনকি পাহাড়ের একটি অংশও পুড়ে লালচে আকার ধারণ করেছে। সোমবার হোয়াইক্যং এলাকা পরিদর্শনে এসে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারের উসকানিতে সাড়া দিলে রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটের বিষয়টি আড়াল হয়ে যেত। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। একটা দেশ এটা করতে পারে না। আমরা ধৈর্য ধরেছি। তবে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য যা করা প্রয়োজন সব করা হবে। আমরা আক্রান্ত না হলে কোনো অ্যাকশনে যাব না। ’
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক কাল : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রকে ব্রিফ করবেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তবে আনুষ্ঠানিক ওই বৈঠকের আগে গতকাল নিরাপত্তা পরিষদের একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে মিয়ানমার পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ব্রিফ করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি এসব তথ্য জানিয়েছে। এদিকে নতুন শরণার্থী ৪ লাখ ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাজাখস্তান, সেনেগাল ও সুইডেনের অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদের এবারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ রাখাইনে চলা সেনা অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেছে। গত সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েপ এরদোগান রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানে সাধারণ পরিষদে উপস্থাপন করেছেন পাঁচ দফা। এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিরল পদক্ষেপ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এতে মিয়ানমার পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়ে দেশটির শান্তি-নিরাপত্তার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা জানান।
অভিযানের ছবি ‘লুকিয়েছে’ মিয়ানমার সেনাবাহিনী : রাখাইন রাজ্যে অভিযানের ছবি ফেসবুক তোলার পর এখন তা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী লুকিয়ে ফেলেছে বলে রয়টার্সের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। রাখাইন রাজ্যে চালানো অভিযানে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সমালোচনায় এখন মুখর। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই দমনাভিযান খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘের উদ্যোগের মধ্যে গতকাল রয়টার্স এক প্রতিবেদনে ফেসবুক থেকে ছবিগুলো লুকিয়ে ফেলার বিষয়টি ধরা পড়ার কথা জানায়। রয়টার্স বলছে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের অফিসিয়াল ফেইসবুক পাতায় ১ অগাস্ট থেকে ২৯ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে পোস্ট করা ছবিগুলো গায়েব করে ফেলা হয়েছে। ওই ফেইসবুক পাতায় ছবিগুলো এখন দেখা না গেলেও নির্দিষ্ট দিনের কিংবা কি ওয়ার্ড সার্চ দিয়ে ছবিগুলো পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ এবং দেশটির সঙ্গে যেসব দেশের সামরিক সম্পর্ক রয়েছে তা পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইস্যুতে মিয়ানমানের নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকায় মানবাধিকার গ্রুপগুলো হতাশা জানিয়েছে। সু চিকে সামরিক জান্তা ১৫ বছর ধরে গৃহবন্দী করে রাখার সময় তার মুক্তির জন্য এসব সংগঠন সোচ্চার ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি মাসের শুরুতে নিরাপত্তা পরিষদ এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।