কনটেইনারভর্তি পণ্য নিয়ে কোটা ওয়েজার নামে একটি জাহাজ দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে ১২ আগস্ট। নয়দিন অপেক্ষার পর সোমবার বার্থিংয়ের সুযোগ পায় জাহাজটি। অন্যদিকে লাকি মেরি নামে আরেকটি জাহাজ প্রবেশ করে ১৪ আগস্ট। এর পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো বার্থিংয়ের সুযোগ পায়নি জাহাজটি। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে খালাসের সুযোগে পাঁচ-ছয়দিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমদানি পণ্যের কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোকে। যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় বন্দরের বহির্নোঙরে কোনো কনটেইনারবাহী জাহাজের একদিনের বেশি অপেক্ষা করার কথা নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস নিয়ে সৃষ্ট এ ভোগান্তির কারণে সমুদ্রপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশমুখী কনটেইনারের পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে বিদেশী নৌ-পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে একদিক থেকে পণ্য আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে খরচ বেড়ে গিয়ে দাম বাড়ছে আমদানি পণ্যের, যা শেষ পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদেরই।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠান ও পরিবহনভেদে চট্টগ্রামমুখী পণ্যভর্তি প্রতিটি কনটেইনারের ভাড়া বেড়েছে ৫০-১৫০ ডলার পর্যন্ত। প্রতি মাসে এখান দিয়ে পণ্য আমদানি হচ্ছে গড়ে এক লাখ টিইইউএসের বেশি কনটেইনারে। পণ্যভর্তি প্রতিটি কনটেইনার পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় গড়ে ১০০ ডলার (৮ হাজার ২০০ টাকা) বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, এ পরিস্থিতি বহাল থাকলে ব্যবসায়ীদের প্রতি বছর অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, যার পুরোটাই চলে যাবে দেশের বাইরে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূলত জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় বেড়ে যাওয়ার কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে চট্টগ্রামমুখী পণ্য পরিবহনের (কনটেইনার) ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে জাহাজ কোম্পানিগুলো। শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় জাহাজ ভাড়া বাবদ এ অতিরিক্ত অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো সম্প্রসারণের যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলেই আমাদের আস্থা ফিরে আসবে। অতীতে আমরা ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে বারবার চাপ সৃষ্টি করলেও বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল।’
বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেন গুপ্তও একই কথা বলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘জাহাজ ভাড়া বাবদ যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে, তা বেরিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আবার আমদানিকারকরা অতিরিক্ত যে অর্থ ব্যয় করছেন, তার প্রতিফলন ঘটছে পণ্যের দামে।’
বন্দরসূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে জেটিতে ভেড়ার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০টি কনটেইনারবাহী জাহাজ অপেক্ষায় থেকেছে। জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক ১৬টিতে। জুলাইয়ে বহির্নোঙরে পণ্য নিয়ে গড় দৈনিক অপেক্ষারত জাহাজের সংখ্যা ছিল ১৭। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন অপেক্ষায় থেকেছে গড়ে ১৫টি কনটেইনারবাহী জাহাজ। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে প্রতিদিন পাঁচটির বেশি জাহাজ অপেক্ষায় থাকার কথা নয়।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সমুদ্রপথে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এখানে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো ও ওঠানোর জন্য মোট ১৩টি জেটি রয়েছে। এছাড়া আরো ছয়টি জেটি বরাদ্দ রয়েছে কনটেইনারবিহীন পণ্যবাহী জাহাজের জন্য। বন্দরের পরিবহন বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কনটেইনার পরিবহন বাড়তে থাকায় প্রতি বছর কমপক্ষে দুটি করে নতুন জেটি নির্মাণ করা জরুরি। যদিও ২০০৭ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য নতুন করে কোনো জেটি নির্মাণ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, একটি বন্দরের দক্ষতা পরিমাপের সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— জাহাজের গড় অবস্থান। সাধারণত এ সূচকের অবনতি ঘটলে বন্দরের সামগ্রিক দক্ষতা পরিমাপেও নেতিবাচক ফল দেখা যায়।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চিটাগংয়ের প্রেসিডেন্ট এসএম আবু তৈয়ব এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জাহাজজট এখন বন্দরের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ড চালানো হলে আজ সেবার মানে এ অবনতি ঘটত না। গত ১০ বছরেও এখানে যেমন কোনো নতুন জেটি নির্মাণ করা হয়নি, তেমনি বন্দরের ইকুইপমেন্টেরও কোনো উন্নতি ঘটেনি। অথচ কার্যক্রমে ১৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।’
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘দেশে অর্থনীতি যে ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে অনেক কিছুই করার রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। এনসিটির জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়াটিতে আমরা প্রায় ৮০ ভাগই এগিয়ে গেছি। গত এক বছরে ৫৫টি যন্ত্র কেনার অনুমোদন পেয়েছি, যার কিছু অংশ এরই মধ্যে চলে এসেছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পতেঙ্গায় একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হবে, যা দুই বছরের মধ্যেই অপারেশনে যাবে। লালদিয়ায় আরেকটি টার্মিনালের ব্যাপারে এরই মধ্যে টেন্ডার ড্রপ হয়ে গেছে। ২০২০ সালের মধ্যে এটি অপারেশনে যাবে বলে আশা করছি। এছাড়া ২০২১ সালে প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালে একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’