‘চলচ্চিত্র নির্মাতা নয়, আমি একজন শিল্পী’

Slider সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

base_1501172806-5555গত বছরের বসন্তে মৃত্যুর সময় আব্বাস কিয়ারোস্তামি জানতেন, তিনি কেবল তার পরিবার-বন্ধুদের নয় বরং নিজের সর্বশেষ কাজটিকেও রেখে যাচ্ছেন। কাজটি অসমাপ্ত রেখেই তিনি দুনিয়াকে বিদায় জানিয়েছেন। আব্বাস কিয়ারোস্তামি ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত পরিচালক ও বহুবিদ্যাবিশারদ। মারা যান ৭৬ বছর বয়সে। মৃত্যুর তিন বছর আগে থেকে তিনি নিজ উদ্যোগে একটি কাজ করছিলেন। ২০১৫ সালে মারাকেশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এ সিনেমার প্রিভিউ ফুটেজের ছোট্ট একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। এর আট মাস পর কিয়ারোস্তামি দুনিয়া ছাড়লেন। ছেলে আহমাদ কিয়ারোস্তামির ওপর এবার পিতার অসমাপ্ত কাজ ‘টোয়েন্টিফোর ফ্রেমস’ শেষ করার দায়িত্ব পড়ল। গত মে মাসের ২৩ তারিখে ফ্রান্সে কান উত্সবে সিনেমাটির প্রিমিয়ার হয়েছিল। সিনেমায় ২৪টি সংক্ষিপ্ত খণ্ডচিত্র আছে, যেগুলোর প্রতিটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ মিনিট। এই খণ্ডচিত্রগুলো তৈরি হয়েছে আব্বাসের পছন্দের আলোকচিত্র নিয়ে, এসব চিত্রের বেশির ভাগ তার নিজের তোলা এবং ৪০ বছরের সংগ্রহ। অধিকাংশ আলোকচিত্রই প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ। পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করা নিয়ে সিএনএন আহমাদ কিয়ারোস্তামির একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছে। সেই সাক্ষাত্কারের চুম্বকাংশের ভাষান্তর—

স্থিরচিত্র নিয়ে এমন কাজ করার প্রেরণা আপনার বাবা কোথা থেকে পেলেন?

বাবা কাজ শুরু করেছিলেন চিত্রকর্ম দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘শিল্পীরা একটা দৃশ্য আঁকেন। কিন্তু সেটা তো একটা দৃশ্য মাত্র। আমার অবাক লাগে সে দৃশ্যের আগে ও পরে কী ঘটেছিল?’

তিনি কাজ শুরু করেছিলেন পিটার ব্রুগেলের ‘দ্য হান্টারস ইন দ্য স্নো’ চিত্রকর্ম দিয়ে। …তার পর বাবা নিজের তোলা ছবি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ৪০টির বেশি ফ্রেম তৈরি করেছিলেন। সবগুলো নিয়ে কাজ শেষ করেননি, কারণ সেগুলো তার মনমতো হয়নি। বর্তমান ফিল্মে আপনারা যতগুলো ছবি দেখবেন, সেগুলোর সবই তার বাছাই করা।

 

এই খণ্ডচিত্রগুলো কীভাবে নির্মিত হয়েছে?

বাবার সঙ্গে যিনি পুরো প্রকল্পে কাজ করেছেন, তার নাম আলী কামালি। এই কামালিই পুরো বিষয়টিকে একত্র করেছেন। তিনি নিজের বাসায় বসে সব অ্যানিমেশন তার কম্পিউটারে করেছেন। বাবা আর কামালি সব কাজই বাসায় বসে করেছেন।

 

প্রকল্পটি শেষ করা কেমন কঠিন ছিল?

প্রকল্পটি শেষ করা বেশকিছু কারণে কঠিন ছিল। সৌভাগ্যক্রমে টরন্টোতে থাকা আমার এক বন্ধু আমাকে কাজে সহায়তা করেছে। সে আমাকে কারিগরি দিকগুলো সামলাতে সাহায্য করেছে। আমার এই বন্ধু বাবাকে খুব ভালোভাবে চিনতেন এবং তার কাজ সম্পর্কে ওর খুব ভালো ধারণা ছিল। এটা পুরো কাজে খুব সহায়ক হয়েছে।

আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল এটা চিন্তা করা যে, আমার বাবা কীভাবে চিন্তা করতেন, সংশ্লিষ্ট দৃশ্যে তিনি কী সিদ্ধান্ত নিতেন। বাবা কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি। কাজের সময় আমাকে মনে রাখতে হয়েছে, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তটা আমার না, বরং আমার বাবার।

 

ফটোগ্রাফি বনাম ফিল্ম— আপনার বাবা এ বিষয়ে কী ভাবতেন?

বাবা সবসময় বলতেন, ‘আমি গল্প বলতে পছন্দ করি না।’ তিনি কখনো তাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করতেন না। বলতেন, ‘আমি একজন শিল্পী। কথা বলার জন্য আমার বিভিন্ন মাধ্যম আছে। ফিল্ম সেগুলোর মধ্যে কেবল একটা।’

শেষ বছরগুলোয় বাবা বলতেন যে তিনি সিনেমা বানানোর চেয়ে ফটোগ্রাফিতে বেশি আনন্দ পাচ্ছেন। কারণ ফটোগ্রাফির জন্য তাকে বাজেট নিয়ে ভাবতে হয় না, বড় একটা টিম সামলানোর ঝামেলা নেই। শেষ এই কাজটিতে তিনি নিজেই অর্থ লগ্নি করেন এবং শুধু একজন সহযোগী নিয়ে কাজ করেন। আমি আলীর সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি জানিয়েছেন বাবা দিনে ১০, ১২ এমনকি ১৪ ঘণ্টা কাজ করেছেন। একটা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাবতেন। এমনও হয়েছে ঘণ্টা ছয়েক একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বলেছেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। ক্লান্ত লাগছে। এবার ছবিগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা যাক।’

 

ফিল্মে কোনো সংলাপ নেই। মানুষের উপস্থিতিও দুর্লভ। খণ্ডচিত্রগুলোর পেছনে কি কোনো গল্প আছে?

প্রতিটি ফ্রেমে কিছু না কিছু ঘটছে। একটা ফ্রেমে আছে পাখির গুলি খাওয়ার দৃশ্য। আমার বাবার এক বান্ধবী ছিলেন, বান্ধবীর চেয়ে তিনি ছিলেন বাবার মেয়ের মতো। তিনি কয়েক বছর আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। বাবা এ খণ্ডচিত্র তৈরি করেছেন তার জন্য। আপনি দেখবেন শুরুর সব নীরব। এর পর দেখবেন পাখির শোক, তার পর পাখিগুলো আবার উড়তে শুরু করেছে।

টোয়েন্টিফোর ফ্রেমসে মানুষের ভূমিকা কী? মনে হয় মানুষকে ধ্বংসাত্মক শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে…

বাবা কখনো মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। আমার মনে হয় তিনি মানুষের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেননি। বরং তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। বাবা বলতেন, ‘প্রকৃতি দেখে তিনি তার চোখ পরিষ্কার রাখেন।’ তিনি একা একা ঘুরতে ভালোবাসতেন। গাড়ি নিয়ে পার্বত্য এলাকায় চলে যেতেন এবং ছবি তুলতেন।

 

টোয়েন্টিফোর ফ্রেমস কি ইরানে প্রদর্শনের পরিকল্পনা করছেন?

হ্যাঁ। আমি ফিল্মটা তেহরান মিউজিয়াম অব কনটেম্পোরারি আর্টে প্রদর্শনের চিন্তা করছি। আমি এখনো এ বিষয়ে আলাপ শুরু করিনি। তবে আমরা তেহরানে প্রদর্শনী করতে চাই, কারণ ইরান আমার বাবা ও তার সিনেমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *