৬ সিটির ভোট দেখে সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ছক

Slider জাতীয়

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতে মানুষকে দলের জনপ্রিয়তা দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছক বা কৌশল চূড়ান্ত করার কথা ভাবছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা। আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভূমিকা, প্রতিপক্ষের শক্তি ও কৌশল, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের ভূমিকা বা দক্ষতা এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। সেই অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশল ঠিক করা হবে। এ জন্য গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহীসহ আসন্ন ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘জিততেই হবে’—এমন মনোভাবের কথা সম্ভাব্য কোনো কোনো প্রার্থীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেভাবে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

এর আগের নির্বাচনে এই ছয়টির মধ্যে রংপুর ছাড়া বাকি পাঁচটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হন। তাই আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।

চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে ছয়টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর। এ ছাড়া ময়মনসিংহকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করে সেখানে নির্বাচন দেওয়া হতে পারে। এ জন্যই ময়মনসিংহ পৌরসভায় মেয়াদ শেষেও নির্বাচন হয়নি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শেষে সিলেটে বদরউদ্দিন আহমদ এবং রাজশাহীতে খায়রুজ্জামানকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্য চার সিটিতেও প্রাথমিকভাবে প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে।

জানতে চাইলে খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকেবলেন, তাঁকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আগের নির্বাচনে তাঁর পক্ষ থেকে প্রচার কম হয়েছে। এবার উঠান বৈঠকসহ ব্যাপক প্রচারণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

আর বদরউদ্দিন আহমদ বলেন, গতবারের মতো এবারও জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোট হচ্ছে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে ভোট হবে দলীয় প্রতীকে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁকে প্রস্তুতি নিতে এবং ঘরে ঘরে যেতে বলেছেন। নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন।

এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের জুন-জুলাইয়ে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়। পাঁচটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিএনপির প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন। তখন এই জয়কে বিএনপি দেশে-বিদেশে তাদের জনপ্রিয়তা এবং সরকারের অজনপ্রিয়তা হিসেবে প্রচার করে। ওই পাঁচ সিটি নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। একতরফা ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হন। যদিও ওই তিন সিটি নির্বাচনে কারচুপি ও জোরজবরদস্তির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিল। বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভোট গ্রহণ চলাকালেই বর্জনের ঘোষণা দেন। এরপর কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে মোটামুটি সুষ্ঠু বলে মেনে নেয় সবাই। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হন। আর কুমিল্লায় পুনরায় মেয়র হন বিএনপির মনিরুল হক। মাঝখানে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জাল ভোট-জবরদস্তির কারণে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

দশম জাতীয় সংসদের মতোই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত হবে ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ নানা চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিএনপির জনপ্রিয়তার কাছে পাত্তা পায়নি। এ জন্য ভয় পেয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রাখার সব কৌশল প্রয়োগ করেছে। এবারও সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি হবে। তবে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রাখার ব্যাপারে এবার সফল হবে না।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলটি আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে। অবশ্য এর আগেই আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল। এর অংশ হিসেবে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিনিধি সভা চলছে। দলীয় কোন্দল নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত মে মাসে সারা দেশের নেতাদের ঢাকায় ডেকে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ এবং বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের বিষয়ে প্রচার চালাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে জরিপ চালানো হচ্ছে। তবে দলীয় সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের মূল কৌশল চূড়ান্ত করা হবে ছয় সিটি নির্বাচনের পর।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক  বলেন, আসন্ন সিটি নির্বাচনগুলো জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আওয়ামী লীগ সব নির্বাচনেই গুরুত্ব দেয়। তবে সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য সর্বাত্মক জোর দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে যুক্ত আছে, এমন একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন দেওয়া ঠিক হবে কি না, এমন একটা আলোচনা দলে ছিল। তবে দলীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এবারের ফল আগেরবারের মতো হবে না। আর কৌশল ঠিক করার জন্য এই নির্বাচন দরকার। এ জন্যই আগে থেকে দলীয় প্রার্থীদের মাঠে নামার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি বর্তমান মেয়রদেরই মনোনয়ন দিতে পারে। কিন্তু তারা পাঁচ বছর মামলা, বহিষ্কার, কারাগার আর আদালতে ঘোরাঘুরি করেই বেশির ভাগ সময় পার করেছেন। মাঠে আওয়ামী লীগই সক্রিয় ছিল।

এ ছাড়া ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সরফুদ্দীন আহমেদ মেয়র নির্বাচিত হন। আগামী আগস্টের পর যেকোনো সময় রংপুরের নির্বাচন করা যাবে। ইতিমধ্যে ওই সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার শুরু করে দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, রংপুরে সরফুদ্দীন আহমেদকেই প্রার্থী করা হতে পারে। সরফুদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে দল থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি। তবে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী এবং প্রচার শুরু করে দিয়েছেন।

বরিশাল ও খুলনাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা আছে। এ ক্ষেত্রে বরিশালে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং খুলনায় সাংসদ শেখ হেলালের পরিবারের কারও সম্ভাবনা রয়েছে। গাজীপুরে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিবেচনায় আছেন। তিনি ২০১৩ সালের নির্বাচনেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজমত উল্লাকে দলের সমর্থন দিয়ে জাহাঙ্গীরকে অনেকটা জোর করেই বসিয়ে দেওয়া হয়।

জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, তিনি ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বিশেষ করে দল-মতনির্বিশেষে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল কাজ করছে।

অন্যদিকে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে এখনো সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয়নি। তবে পৌরসভার মেয়াদ শেষ হলেও ভোট হয়নি। যেকোনো সময় সিটি করপোরেশন ঘোষণা করে ভোট দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পৌর মেয়র একরামুল হককেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার সম্ভাবনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে  বলেন, আসন্ন ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে জয় চান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিটি করপোরেশনগুলোতে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম বলে প্রস্তুতি নেওয়ারও তাগিদ দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *