গত দুই সপ্তাহে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে যোগাযোগ করে জানা গেছে, নারী গৃহকর্মীদের সৌদি আরবে পাঠানোর দুই বছর পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে এ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন প্রায় দেড় হাজার নারী। এর বাইরেও বেশ কিছু নারী নিজেদের চেষ্টায় দেশে ফিরেছেন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের সঙ্গে নারী গৃহকর্মী নিয়ে চুক্তি সইয়ের পর এখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে গেছেন প্রায় দেড় লাখ নারী। এ বছরের প্রথম চার মাসে সৌদি আরবে যাওয়া নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩১১।
নারী গৃহকর্মীদের উল্লেখযোগ্য হারে সৌদি আরবে যাওয়া অব্যাহত থাকায় তাঁদের ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশকে দ্রুত আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়েছেন কূটনীতিক ও শ্রমিক অধিকারকর্মীরা।
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, খুনের দায়ে ইন্দোনেশিয়ার দুই নারীকে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদের প্রতিবাদে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে গৃহশ্রমিক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্দোনেশিয়ার দাবি, নির্যাতনের শিকার হওয়া ওই দুই নারী আত্মরক্ষার্থে সৌদি নাগরিকদের খুন করতে বাধ্য হয়েছেন। নির্যাতনসহ নানা রকম অভিযোগের কারণে ফিলিপাইনও ২০১৫ সালে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন ছাড়া অন্য দেশগুলোর শ্রম আইনে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের সুযোগ নেই। আইনি সুরক্ষা না থাকায় কম বেতন কিংবা বিনা বেতনে কাজ করা, কাজের সময়ের কোনো পরিসীমা না থাকা, ছুটি না থাকা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনসহ সব ধরনের নিপীড়নের ঝুঁকি থাকে নারী গৃহকর্মীদের। কাজেই সুরক্ষার এ দিকগুলো নিশ্চিত করার আগেই তাড়াহুড়া করে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করাটা ঠিক হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বের হলেও এক বছর আগেই দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এ নিয়ে ঢাকায় সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে চুক্তির এক বছর পরই, অর্থাৎ ২০১৬ সালের মার্চে ঢাকায় এমন একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে বাংলাদেশের গৃহকর্মী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতিতদের সংখ্যাও বাড়ছে। অসুস্থতা, বাড়ির জন্য কাতর হওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ভাষার সমস্যার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বাড়ছে ব্যাপক হারে।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যা যা করার সবকিছুই আমরা করছি।’
সৌদি আরবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের প্রথমার্ধে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে নারী গৃহকর্মী পাঠানো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর বিরতির পর বাংলাদেশের জনশক্তির সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার পুনরায় চালুর সুযোগ নিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি মহল উপেক্ষা করেছিল দূতাবাসের দেওয়া পরামর্শ।
জানতে চাইলে রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন ও কাজ না পাওয়া, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের কারণে গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হোমে চলে আসেন নারী গৃহকর্মীরা। এ জন্য সৌদি আরবে পাঠানোর আগে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে ঢাকায় বারবার জানানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সমস্যা দূর করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
এর আগে গত সপ্তাহে রিয়াদে বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সেলর মো. সরওয়ার আলমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুটি সেফ হোমে আড়াই থেকে তিন শ নারীকে রাখার ব্যবস্থা আছে। আশ্রয় নেওয়া এসব নারীর অভিযোগগুলো সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুরাহার পর তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে এ বছরের মে পর্যন্ত সেফ হোম থেকে প্রায় দেড় হাজার নারীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ বছরের মে মাস পর্যন্ত সেখানে বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের মধ্যে ২২ জন নানা কারণে মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের এসব সমস্যা সুরাহার জন্য সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়া যৌথ কারিগরি কমিটিতে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তা সুরাহার কথা রয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আলোচনার কথা থাকলেও তা হয়নি।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অনেক দিন পর দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ায় আমাদের ধারণা ছিল, সৌদি আরব বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে সংগত আচরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কাজেই বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাজের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি তাঁদের মানবাধিকার সুরক্ষা করতে হবে।’
সৌদি আরবে যাওয়া প্রায় ৫০ জন নারী কর্মীর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গত বছর দূতাবাস ঢাকায় একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডজনখানেক কারণে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব কারণের মধ্যে আছে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ-আতঙ্ক, গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বেতন না দেওয়া, ফোন কেড়ে নেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে গেলে থানায় চুরি ও নাশকতার মামলা দেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে পুলিশের আশ্রয়ে গেলে আবার আগের নিয়োগকর্তার কাছে ফেরত পাঠানো, অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করা, বেশি অসুস্থ হলে রাস্তা কিংবা দূতাবাসের সামনে ফেলে যাওয়া এবং দূতাবাসকে না জানিয়ে ক্রীতদাসের মতো এক এজেন্সি থেকে অন্য এজেন্সিতে বিক্রি করে দেওয়া উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থায় সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী পাঠানো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।
ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে নির্যাতনের কারণে অন্তত পাঁচজন আত্মহত্যা করেছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন, যাঁদের দুজন সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। আর বাকিরা নানা রকম অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বোমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম গত বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে যাওয়া নারী কর্মীদের কম বেতন এবং নির্যাতনের অভিযোগ কমেনি, বরং বেড়েছে। গত বুধবার প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সৌদি আরবে নারী কর্মীদের নির্যাতন কমানো এবং সুরক্ষার স্বার্থে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, কাজ শেষে রাত্রিযাপনে তাঁদের জন্য আলাদা আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাজেট বাড়ানো।’