বাবা-মেয়ের আত্মহনন: পুলিশি তদন্তের সময় বাড়লো আরো ৭দিন

Slider টপ নিউজ নারী ও শিশু

18254264_184478722074630_1837582483_n

 

ঢাকা;   স্বামী-মেয়ের শোকে তিনিও এখন শয্যাশায়ী। মৃত্যু পথযাত্রী। হালিমার বাড়িতে বসেছে পুলিশি পাহারা। দেখাশুনা করছেন দুই গ্রাম পুলিশ। রয়েছেন স্বজনরাও। গত ৩০শে এপ্রিল গাজীপুর জেলার শ্রীপুর কর্নপুর গ্রামের বৃদ্ধা হালিমার স্বামী হযরত আলী তার মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে ফারুক নামে স্থানীয় এক বখাটে তার ৮ বছরের মেয়ের শ্লীলতাহানি করে বলে অভিযোগ ওঠে। পরে এ বিষয়ে থানা-পুলিশ করলে অভিযুক্ত ফারুক ভূমিহীন এই দম্পতির একটি গরু চুরি করে নিয়ে যায়। হালিমার দাবি- মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে এবং অপরাধীদের একের পর এক নির্যাতনে অপমানে-ক্ষোভে-দুঃখে তার স্বামী এই ঘটনা ঘটায়। এদিকে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়। বেরিয়ে আসতে থাকে নেপথ্যের নানা ঘটনা। নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ হাজির হয় হালিমার বাড়িতে। গত ১লা মে হালিমাকে দেখতে যান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। ওই সময় তিনি বাবা-মেয়ের মৃত্যুর পেছনে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচারহীনতাকে দায়ী করেন। অভিযুক্তদের ধরতে তিনি ৭২ ঘণ্টার সময়ও বেঁধে দেন। তবে বেঁধে দেয়া এই সময় আরো তিনদিন আগে অতিবাহিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন প্রধান অভিযুক্ত ফারুকসহ ৬ আসামি। এ মামলায় এ পর্যন্ত একজন আসামি ধরা পড়েছে। এদিকে মূল অভিযুক্ত আসামি ধরার ব্যাপারে পুলিশের তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। উল্টো পুলিশ বলছে, আসামি ধরার ব্যাপারে কেউ তাদের সময় বেঁধে দেয়নি। তবে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, আসামি ধরতে পুলিশের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অপরদিকে এ ঘটনায় পুলিশের গঠন করা তদন্ত কমিটিও ৩দিনের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারেনি। ফলে প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা আরো ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে।
জানা যায়, কর্নপুর গ্রামের হালিমার সঙ্গে ৩০ বছর আগে বিয়ে হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকা থেকে আসা হযরত আলীর। এরপর ভূমিহীন এই দম্পতি বসতি গড়েন সরকারি খাস জমিতে। হযরত আলী দিনমজুরের কাজ করতেন আর হালিমা ছিলেন স্থানীয় শ্রীপুর থানার রাঁধুনি। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তারা নিঃসন্তান ছিলেন। ৮ বছর আগে তারা নিঃসন্তান জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে ৪-৫ মাসের কন্যাশিশুকে দত্তক নেন। সেই কন্যাকে ঘিরেই তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। লেখাপড়া শেখাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশী কয়েক ব্যক্তির অত্যাচারে এই সুখের সংসারে মাঝে মধ্যেই অশান্তি নেমে আসতো। এরই ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারি মাসে তাদের শিশুকন্যার ওপর শ্লীলতাহানি করে একই গ্রামের ফজলুর ছেলে বখাটে ফারুক (৩০)। এরপর তিনি সমাজপতি ও থানা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। থানার পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জানান, হালিমা আগে থানায় রান্না করলেও সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু গত মাস দুই আগে থেকে তিনি কয়েকদিন পরপর থানায় যেতেন। তখন কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি বা খতিয়ে দেখেনি। তবে পুলিশের ভাষ্য, ওই সময় হালিমার একটি লিখিত অভিযোগ নেয়া হয়েছিলো। ঘটনাটি আলোচনায় আসার পর পুলিশ এ বিষয়টি জানায়। তবে ওই অভিযোগে দেখা যায়, কোথাও শ্লীলতাহানির বিষয়টি উল্লেখ নেই। হালিমার বক্তব্যের সঙ্গে আংশিক মিল থাকলেও শ্লীলতাহানির বিষয়টি আসেনি। ফলে এই অভিযোগ নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। হালিমার স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, ওই সময় অভিযোগ না নিলেও পুলিশ একবার বাড়িতে এসেছিলো। এ কথা জানার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য আবুল হোসেন মেম্বার পুলিশকে ঘটনাটি সাজানো বলে জানালে তদন্ত মাঝপথে থেমে যায়। এদিকে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযুক্ত ফারুক হযরত আলীর একটি গরু চুরি করে নিয়ে যায়। এ নিয়েও সমাজপতিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেন হালিমা-হযরত আলী দম্পতি। অবশেষে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও অপমানে গত ৩০শে এপ্রিল ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।  গতকাল সরজমিন হালিমার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি শয্যাশায়ী। তার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে জানান, তিনি প্রায়ই তার স্বামী ও মেয়ের কবরের পাশে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন। ঘুমাতে পারছেন না। অল্প সময়ের জন্য ঘুমালেও ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠছেন। মাঝে মাঝেই তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ঘটনার সঠিক বিচার নিয়ে তারাও শঙ্কায় রয়েছেন। তাদের ধারণা- পুলিশের সদিচ্ছা থাকলে এতদিনে আসামি ধরা পড়তো। এ ব্যাপারে পুলিশের কোনো তৎপরতা তাদের চোখে পড়েনি বলেও জানান। একই অভিযোগ করেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আসামি কারো অচেনা নয়। এলাকারই। তারা আশেপাশেই লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশের পুলিশের সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ চেষ্টা করলেই সব আসামিকে ধরতে পারতো। মনে হচ্ছে তাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, আসামিকে ধরে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এদিকে শ্রীপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আসামি ধরতে আমাদের কেউ সময় বেঁধে দেয়নি। আমরা এ ধরনের কোনো নির্দেশনা পাইনি। আসামি এখনো ধরা পড়েনি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই কেসটা নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে আসামিরা সাবধান হয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ২রা মে পুলিশের পক্ষ থেকে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়। একটি কমিটি গঠন হয় পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) পক্ষ থেকে। অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলীকে প্রধান করে চার সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। অপর কমিটি গঠন করা হয় গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম সবুরকে প্রধান করে। গোলাম সবুর গতকাল  বলেন, কমিটি গঠন হওয়ার তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তদন্তের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার আরো ৭ দিনের সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্তাধীন বিধায় এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *