মন্ত্রীর বাসায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত?

Slider জাতীয়

95e2cea076a1a359fa5d8772892e04b8-58b5d78f37226

ঢাকা; এ যেন দুর্ভোগের মহামিছিল। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ করে গাড়ি বন্ধ করে যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেন পরিবহনশ্রমিকেরা। রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায় অধিকাংশ গণপরিবহন। এই দুর্ভোগের মধ্যে শত শত মানুষ কোনো উপায় না পেয়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন।  যাত্রীদের জিম্মি করে আদালতের রায় বদলানোর কৌশল নিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এবার এই কৌশল বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এল সরকারের একজন মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বসে। আর এই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং সরকার-সমর্থক পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
গত সোমবার দুপুরে খুলনা সার্কিট হাউসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের বৈঠক শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু রাতে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সরকারি বাসভবনে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। গভীর রাতে ঘোষণা আসে, মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে লাগাতার পরিবহন ধর্মঘট। আকস্মিক এই ঘোষণার শিকার হয় সাধারণ মানুষ।
নৌমন্ত্রী সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। ওই বৈঠকে বাস ও ট্রাকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার পল্লিউন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ প্রায় ৫০ জন মালিক-শ্রমিকনেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের প্রায় সবাই সরকার-সমর্থক বলে পরিচিত।
.শাজাহান খানের বাসায় বৈঠকের বিষয়ে মসিউর রহমান  বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য। শ্রমিকেরাও রাজি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ফাঁসির রায়ের খবর আসলে শ্রমিকেরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখন আর আমাদের কিছু করার ছিল না।’
মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্র জানায়, বৈঠকে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করার কৌশল নেওয়া হয়। কারণ, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ও সরকার সমর্থকেরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। তাই দায় এড়াতেই এমন কৌশল নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় নেতারাই ফোনে আঞ্চলিক নেতাদের ধর্মঘট পালনের নির্দেশ দেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সচিবালয়ে এই ধর্মঘটকে দুঃখজনক উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁদের (পরিবহনশ্রমিক) উদ্দেশে বলতে চাই, জনগণকে কষ্ট না দিয়ে আপনারা আদালতে এসে আপনাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। আপনাদের বক্তব্য যদি যুক্তিসংগত হয়, তবে তা দেখা হবে। যুক্তিসংগত না হলে দেখা হবে না।’ এই ধর্মঘটে আদালত অবমাননা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, এটি আদালতের বিবেচ্য বিষয়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, মালিক-শ্রমিকদের নেতারা আজ বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তাঁরা ধর্মঘট থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ খুঁজছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলায় ঘাতক বাসের চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এই রায়ের প্রতিবাদে প্রথমে আঞ্চলিকভাবে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
এদিকে সাভারে ট্রাকচাপায় এক নারীকে হত্যার দায়ে চালকের বিরুদ্ধে সোমবার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। এরপরই গতকাল থেকে সারা দেশে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে যাওয়া কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান  বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে যে কেউ উচ্চতর আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। কিন্তু পেশিশক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে সারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ নেই। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হবে।
হঠাৎ ধর্মঘটে ভোগান্তি
হঠাৎ ধর্মঘটের কারণে কাল সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানী ও আশপাশসহ সারা দেশের মানুষ। সোমবার সন্ধ্যায় ও রাতে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক যাত্রী ও পণ্যসহ আটকা পড়ে। সকালে গাবতলী, কাঁচপুর সেতু, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার সব প্রবেশমুখে যানবাহন আটকে দেওয়া হয়। দূর থেকে আসা যাত্রীরা টার্মিনালের অনেক দূরে নেমে হেঁটে, রিকশায় ও রিকশাভ্যানে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আবার রাজধানী শহরের ভেতরেও সীমিতভাবে যানবাহন চলে।
এই দুর্ভোগের পরও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ধর্মঘটের পক্ষেই সাফাই গাইলেন। তিনি গতকাল  বলেন, ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে। আপনিও করেন, আমিও করি। ঠিক একইভাবে ওরাও (শ্রমিক) ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, চালকেরা মনে করেছেন, তাঁরা মৃত্যুদণ্ডাদেশ বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তাই তাঁরা স্বেচ্ছায় গাড়ি চালাচ্ছেন না। এটাকে ধর্মঘট নয় ‘স্বেচ্ছায় অবসর’ বলা যেতে পারে।
নৌমন্ত্রী স্বেচ্ছা অবসর বললেও ধর্মঘট আহ্বানকারীরা গতকাল দিনভর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীদের বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে। কোথাও কোথাও বাসের চালককেও নামিয়ে দেওয়া হয়। সিএনজি অটোরিকশা চালকদেরও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর গাবতলীতে আটকেপড়া ব্যক্তিগত গাড়িগুলোকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা গেছে। চট্টগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী  বলেন, অনেক সময় পুলিশ ছোটখাটো আন্দোলন কর্মসূচিতেও চড়াও হয়। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটে পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয় ও নীরব দর্শক। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের সামনেই যাত্রী ও চালককে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। আসলে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সরকারের লোক। জনস্বার্থে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত তাঁরাও মানেন না।
মালিক-শ্রমিকেরা ‘বার্তা’ দিতে চান
মালিক-শ্রমিক সংগঠনের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা জানান, সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় দায়ী চালকের বিরুদ্ধে সাজা দেওয়ার নজির নেই। দুর্ঘটনার জন্য মালিকদের মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণও দিতে হয়নি। কিন্তু পরপর দুটি ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার ঘটনায় পরিবহনশ্রমিকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ভবিষ্যতে এ ধরনের মামলায় আরও সাজা হতে পারে, এ আশঙ্কায় তাঁরা সবাইকে একটা ‘বার্তা’ দিতে চান। এ থেকেই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শাজাহান খানের বাসায় বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক মালিক ও শ্রমিকনেতা জানান, মালিকদের সংগঠনগুলো ধর্মঘটের বিষয়ে খুব বেশি সোচ্চার ছিল না। আবার শ্রমিক সংগঠনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মত দেওয়ারও সাহস দেখায়নি। বৈঠকের শুরুতে খুলনা অঞ্চলের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে সরকারকে সময় বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছিল। এ সময় ঢাকা অঞ্চলের ট্রাকমালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে খবর দেওয়া হয় যে, দুর্ঘটনায় এক নারীর প্রাণহানির কারণে একজন ট্রাকচালকের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। এরপর নেতারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনো কোনো নেতা ওই মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। নিশ্চিত হওয়ার পর ধর্মঘট প্রত্যাহারের আলোচনা আর এগোয়নি।
মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের দুজন দায়িত্বশীল নেতা দাবি করেন, বিষয়টি এখন নেতাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। শক্ত কর্মসূচি না নিলে তাঁদের নেতৃত্বই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
তবে একাধিক সাধারণ পরিবহনমালিক জানিয়েছেন, ধর্মঘট জনগণের জন্য যেমন দুর্ভোগের, তেমনি মালিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ, অনেক মালিক পরিবহন চালিয়ে দৈনিক ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। ব্যবস্থাপনার খরচও মেটাতে হয়।
গতকাল এক আলোচনা সভায় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধর্মঘটকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আদালত এ রায় দিয়েছেন, জনগণ দেয়নি। এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক নেই। তাহলে জনগণ কেন কষ্ট পাবে?
মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্র আরও জানায়, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের স্বজনেরা মানিকগঞ্জের আদালতে দায়ী বাসের মালিকের বিরুদ্ধে ১৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আলাদা একটি মামলা করেছিলেন। পরে বাদীর আবেদনে সেই মামলা হাইকোর্টে স্থানান্তর হয়। এই মামলায় এখন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ৭ মার্চ শুনানির দিন ধার্য আছে। সিলেটের একটি সড়ক দুর্ঘটনায় গ্রীন লাইন পরিবহনের মালিকের বিরুদ্ধেও আরেকটি ক্ষতিপূরণ মামলা চলমান আছে। এই দুটি মামলা নিয়ে মালিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যেও শঙ্কা আছে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকেরা যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে পার পেয়ে আসছিলেন। এই দুটি মামলায় বিপুল ক্ষতিপূরণ দেওয়ার শঙ্কা দেখছেন তাঁরা।
সূত্র আরও জানায়, পরিবহনমালিকেরা সারা দেশে দুই লাখের ওপর ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বাসের আকৃতি পরিবর্তন করেছেন। যা মোটরযান আইনের পরিপন্থী। সরকার এটাকে সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বাসের মালিকদের নিজ খরচে মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা এসব যান মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে নেওয়ার বিপক্ষে এবং তাঁরা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি। কারণ, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন কমে যাবে।
ধর্মঘটের পেছনে মন্ত্রী ও সরকারি দলের লোকজনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘মন্ত্রীদের এই ভূমিকার জন্য সরকারের বিব্রত হওয়া উচিত। আমি বলব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দৃঢ়চেতা হতে হবে। মন্ত্রীদের একটা ধাক্কা দেওয়া উচিত যে, সরকারি দায়িত্বে থেকে খেয়ালখুশিমতো চলা যাবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *