৫ নভেম্বর ২০১৪, বুধবার, ৯:০৯
জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল গত রমজানে। আমি তখন কাসিমপুর কারাগারে বন্দী। সে দিন আমাকে একজন চোর-গুণ্ডা বা বদমাশের মতো মহা যতন করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে দিন আমার নামের সাথে এমপি নামক একটি পদবিও ছিল। আমাকে নেয়া হলো প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে- তারপর কী মনে করে যেন সন্ধ্যার পরপরই পাঠানো হলো কাসিমপুর। গভীর রাতে আমি যখন কারা ফটক অতিক্রম করে আমার বন্দিনিবাসের দিকে যাচ্ছি, তখন ক্ষুধা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং অপমান আমাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। জীবনের প্রথম কারাবাস- আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ ওখানে যায়নি- আর তাই আমি জানতাম না ওখানকার নিয়মকানুন, সুযোগ সুবিধা বা অসুবিধাগুলো।
কাসিমপুর কারাগারের মূল ফটক পার হয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয়। তখন সম্ভবত ১৪ বা ১৫ রোজা চলছিল। আকাশে অর্ধচন্দ্রের মিষ্টি আলো। আমি হাঁটছি, সাথে দুজন কারারক্ষী। চার দিকে গা ছমছম করা সুমসাম নীরবতা। ভয়ে ভয়ে কারারক্ষীদের বললাম- আমি যেখানে থাকব সেখানে আর কে কে আছেন। তারা বলল- মীর কাসেম, মাহমুদুর রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। রাতে কারো সাথে দেখা হবে না, তবে সকালে দেখতে পাবেন সবাইকে। সকালে দেখা হলো মীর কাসেমের সাথে। করমর্দন করলেন এবং আমার দিকে অতীব আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে! কোথায় যেন দেখেছি! আমি বললাম, টিভিতে দেখেছেন। তিনি ও আচ্ছা বলে তখনকার আলোচনার ইতি টানলেন। আমি কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হলাম। কারণ মাহমুদুর রহমান কিংবা গিয়াস উদ্দিন আল মামুন যতটা আন্তরিকতা, আগ্রহ এবং খোলামেলা ব্যবহার দেখালেন, সে তুলনায় মীর কাসেমের অভিব্যক্তি ছিল স্বতন্ত্র। আমার মনে হলো- লোকটি ভীষণ রাশভারী, বেরসিক অথবা মনেপ্রাণে প্রচণ্ড আওয়ামীবিদ্বেষী। কিন্তু আমার সেই ভুল ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
রোজার মাসে আমরা ইফতারি এবং রাতের খাবার একসাথে খেতাম। রোজার পর সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবার একসাথে খেতাম। প্রথমে আমরা ছিলাম চারজন, পরে আমাদের সাথে যোগ হন অপর জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার। তাকে গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে কাসিমপুরে আনা হয় রমজানের ঠিক কয়েক দিন পর। আমরা ফজর ছাড়া বাকি নামাজ জামাতে আদায় করতাম। আর প্রতি বিকেলে আমাদের ভবনের সামনে খোলার মাঠে চেয়ার নিয়ে বসে গল্পগুজব করতাম- আবার মাঝে মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতাম। দু-তিন দিন পর আমার সাথে অন্য সবার মতো মীর কাসেমের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং আমরা পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে বন্ধুর মতো আচরণ করতে থাকি।
জেলখানার অখণ্ড অবসরে আমি প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠতাম। নামাজ-কালাম, তসবিহ-তাহলিল, বই পড়া, ঘুম, ব্যায়াম- সব কিছু রুটিন মতো করার পরও হাতে অনেক সময়। মন ভার হলেই আমি বারান্দায় পায়চারি করতাম। মীর কাসেম তখন পরম স্নেহে আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেন নতুবা আমার রুমে আসতেন। তিনি কথা বলতেন কম এবং শুনতেন খুব বেশি। তিনি আমার জীবন, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ, সংসার, নির্বাচনী এলাকার খুঁটিনাটি নিয়ে মেধাদীপ্ত প্রশ্ন করতেন এবং সব কিছু শোনার পর সুন্দর বা আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত থাকতেন। কয়েক দিন পর আমি বুঝলাম মীর কাসেম সমাজের অন্য মানুষের মতো নন। এ আমি বুঝেছিলাম তার আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস ও ইবাদত বন্দেগির ধরন দেখে। যেসব বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগত, আমি নির্দ্বিধায় সেগুলো তাকে জিজ্ঞেস করতাম এবং তিনি সাধ্য মতো সুন্দর করে আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন।
জেলে যাওয়ার আগে বহুজনের কাছে বহুবার তার ব্যাপারে বহু কথা শুনেছি। তার নাকি আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তিনি জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা, দেশে-বিদেশে তার রয়েছে নামে বেনামে বহু প্রতিষ্ঠান। দেশের মধ্যে চলাফেরার জন্য তিনি সব সময় নাকি নিজস্ব হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন ইত্যাদি। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় গুজবটি হলো- তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিলেন। আমি এসব গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করতাম না। আবার যারা ওসব বলত তাদের সাথে তর্কও করতাম না। কারণ, গুজবকারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্তর এত নিচু মানের যে, তাদের সাথে তর্ক করাটাই মস্তবড় এক নির্বুদ্ধিতা। আমি নিজে ব্যবসাবাণিজ্য করি সেই ১৯৯১ সাল থেকে। বাংলাদেশে কয়জন ধনী আছেন এবং কোন কোন ধনীর কী কী ব্যবসা আছে তা মোটামুটি নখদর্পণে। বাংলাদেশের ধনীদের বসবাসের কয়েকটি এলাকা আছে- তাদের মেলামেশার জন্য কয়েকটি ক্লাব আছে, তাদের ব্যক্তিগত বিলাসিতার গাড়ি, বাড়ি, নারী, বাগানবাড়ি, বন্ধু-বান্ধব, সভা-সমিতির এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের নাম ধাম অনেকের মতো আমিও জানি। ওই সমাজে মীর কাসেম নামে কোনো লোক নেই। মিরপুরের কোনো এক জায়গায় পাঁচ কাঠার ওপর নির্মিত একটি পৈতৃক বাড়িতে স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি অন্য ভাইদের সাথে ভাগাভাগি করে থাকেন।
মার্কিন রাজনীতি, অর্থনীতি ও লবিস্ট ফার্ম সম্পর্কে আমার ধারণা বাংলাদেশের অনেকের চেয়ে স্পষ্ট। কারণ ওই বিষয়ের ওপর আমার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপ রয়েছে। ওখানকার লবিস্ট ফার্মগুলো কী কী কাজ করে বা করতে পারে তা আগে জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করবে? যুক্তরাষ্ট্র কেন- পৃথিবীর কোনো দেশের কি সেই ক্ষমতা আছে? আর আমরাই কি সেই আগের অবস্থায় আছি? যেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন ধরেন না! বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সাক্ষাৎকার দেন না, সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত তারানকোর সাথে সাক্ষাৎ করেন না, সেখানে কোনো লবিস্ট ফার্ম কী করবে তা নিয়ে গল্প বানানোর নির্বুদ্ধিতা আমার সাজে না। মার্কিন সমাজের বেশির ভাগ নাগরিক দিন আনে দিন খায়। শতকরা ৯০ ভাগ লোকের সামনে পাঁচ হাজার ডলার নগদ ফেললে তারা ভয় পেয়ে যায়। কাজেই বাজারের গুজব নিয়ে কথা না বলে আমি কথা বলতাম ১৯৭১ সাল নিয়ে এবং জানার চেষ্টা করতাম ওই সময়ে তার ভূমিকা সম্পর্কে।
একদিন কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জেলে থাকার কারণে আপনার ব্যবসাবাণিজ্যের কি কোনো সমস্যা হচ্ছে না? তিনি বললেন, ঝামেলার মতো কোনো ব্যবসাবাণিজ্য নেই। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক একটি ডেভেলপার কোম্পানি আছে। এখন ফ্ল্যাট ব্যবসায়ের বাজার মন্দা থাকায় নতুন কোনো প্রজেক্ট নেই। সেন্ট মার্টিন টেকনাফ রুটে দুটি জাহাজ চলে কেয়ারী সিন্দবাদ নামে। সিজনাল ব্যবসা। ভালো চলছে। অন্য দিকে নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টিভিতে অনেক পরিচালক আছেন আর উভয় কোম্পানিই পাবলিক লিমিটেড। কাজেই টেনশন নেই। ব্যবসাবাণিজ্য ছেলেরাই দেখাশোনা করে। অন্য দিকে ইবনে সিনা বা ইসলামী ব্যাংকে আমার পরিচালক পদ অনেকটা অনারারি ধরনের। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক জামায়াত নেতার মতো আমিও ছিলাম পরিচালনা পরিষদে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া এবং পরিচালন পদ্ধতি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো নয়। যেমন- ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাদের এক টাকার মালিকানাও ব্যাংকটিতে ছিল না।
আমি মীর কাসেমের কথা শুনছিলাম এবং তার রুমের চার দিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। জামা-কাপড়, সাজসজ্জা, আসবাবপত্র কোনো কিছুই আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়নি, বিশেষ করে ডিভিশনপ্রাপ্ত অন্য কয়েদিদের তুলনায়। আমরা সবাই জেলখানার ভেতরের দোকান থেকে কিনে মিনারেল ওয়াটার খেতাম। অন্য দিকে মীর কাসেম খেতেন সাধারণ ট্যাপের পানি। কোনো বিদেশী ফলমূল খেতেন না। জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, কলা প্রভৃতি দেশী ফল সময় ও সুযোগ মতো খেতেন। আমাদের সবার রুমে ছয়টি করে সিলিং ফ্যান ছিল। আমরা নিজেরা সব সময় সব ফ্যান ছেড়ে রাখতাম। মীর কাসেম ভুলেও সে কাজটি করতেন না- দরকার পড়লে একটি মাত্র ফ্যান ছাড়তেন। তার এই অবস্থা দেখে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রায়ই বলতেন- স্যার, এত টাকা দিয়ে কী করবেন! তিনি জবাব না দিয়ে শুধু হাসতেন। ইতোমধ্যে আমার সাথে তিনি আরো খোলামেলা এবং আন্তরিকতা দেখাতে লাগলেন। আর এই সুযোগে আমিও নানা রকম বেফাঁস কথা বলে তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতাম। একদিনের একটি কথার জন্য আমার আজো আফসোস হয়, কেন আমি অমন করে সে দিন ওকথা বলতে গিয়েছিলাম। ঘটনার দিন বিকেলে আমি, মাহমুদুর রহমান ও মীর কাসেম আমাদের কারা প্রকোষ্ঠের সামনের মাঠটিতে চেয়ারে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমি প্রশ্ন করলাম- ভাই, আপনার ওজন কত? তিনি বললেন, ৯২ কেজি? আমি বললাম, সর্বনাশ, তাড়াতাড়ি কমান! না হলে সিরিয়াস ঘটনা ঘটে যাবে। কী ঘটনা ঘটবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম- হাবভাবে মনে হচ্ছে আপনার ফাঁসি হবে! তিনি বললেন- তাতে কী? আর ফাঁসির সাথে ওজনের কী সম্পর্ক? আমি বেকুবের মতো বলে ফেললাম- শুনেছি শায়খ আবদুর রহমানের অতিরিক্ত ওজনের জন্য তার লাশ ফাঁসিতে ঝুলানোর একপর্যায়ে ঘাড় থেকে…। আমার কথা শুনে তিনি শিশুর মতো হো হো হেসে উঠলেন। তারপর হাসতে হাসতে আসমানের পানে তাকালেন এবং বললেন, এমপি সাহেব! সব ফয়সালা তো ওই আসমান থেকেই আসবে! আমার মুখের ওপর যেন বজ্রপাত হলো, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। আমি অনেকটা অমনোযোগী হওয়ার ভান করে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলাম; কিন্তু কিছুতেই নিজের দুর্বলতা গোপন রাখতে পারলাম না। আমি তার মুখপানে তাকালাম। আমার চোখ অস্বস্তিতে জ্বালাপোড়া করতে লাগল। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে চোখের যন্ত্রণা আড়াল করতে চেষ্টা করলাম। তিনি তখনো আকাশের পানে তাকিয়ে ছিলেন।
এ ঘটনার পর আমি মনে মনে তওবা করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনে আর বেফাঁস কথা বলব না। মাহমুদুর রহমান, মামুন ও আমি বেশির ভাগ সময়ই রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করতাম। আর মীর কাসেম শুধু শুনতেন। একদিন মামুন বললেন- স্যার! আমি আপনার মতো বেকুব লোক জিন্দেগিতে দেখিনি। আপনি তো বিদেশ ছিলেন। দেশে এসে ধরা দিলেন কোন? তিনি শিশুর মতো প্রশ্ন করলেন- বিদেশে কেন থাকব? মামুন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন- শোনেন! কথা শোনেন! তিনি মামুনের কথার জবাবে বললেন- আমি তো নিজে জানি যে আমি কী করেছি! তাই নিজের কর্মের ওপর বিশ্বাস করেই দেশে ফিরেছিলাম। তা ছাড়া দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতিও আমার আস্থা ছিল। তার উত্তর শুনে মামুন মহা বিরক্ত হয়ে বলল- স্যার খান! আরেকটি রুটি খান। আমি আর মাহমুদুর রহমান মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম।
মীর কাসেমের দুটি অভ্যাস নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে তিনি একেক সেট পোশাক পরতেন। আমরা চার ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতে গিয়ে দেখতাম প্রতিবারই তিনি পোশাক পরিবর্তন করে আসতেন। মামুন ছিলেন দারুণ মুখপোড়া প্রকৃতির। বলতেন, কেন চার বেলা পোশাক পরিবর্তন করেন? তিনি বলতেন, চার বেলা নয় আমি তো পাঁচ বেলা পোশাক পরিবর্তন করি। একজন রাজা বাদশাহ বা সম্মানিত লোকের দরবারে আমরা যেমন পরিপাটি নতুন পোশাকে হাজির হই, তেমনি আল্লাহর দরবারে হাজির হতে গিয়ে আমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পোশাক পরিবর্তন করি।
পোশাক পরিবর্তন ছাড়াও তার আরেকটি অভ্যাস ছিল- প্রতি বিকেলে নিচে নেমে সবার সাথে সালাম বিনিময় ও করমর্দন করা। আমাদের সেলের প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি রাস্তা চলাচলকারী আসামি ও অন্য সেলের কয়েদিদের সাথে সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। আসামিদের মধ্যে কিলার আব্বাসসহ বেশ কয়েকজনের বাড়ি ছিল মিরপুরে। তিনি তাদের সাথে একটু বেশি আন্তরিকতা দেখাতেন। মামুন টিপ্পনী কাটতেন- স্যার, মিরপুর থেকে ইলেকশন করবেন তো! তাই জেলে বসেই সব কিছু ঠিকঠাক করছেন। তিনি শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিতেন- আরে নাহ কোনো ইলেকশন না। আমি প্রতিবেশীর হক আদায় করার চেষ্টা করছি।
যে দিন তার কোর্টে হাজিরা থাকত, সে দিন সকালে তিনি আমাদের সবাইকে সালাম জানিয়ে যেতেন। ট্রাইব্যুনালে হাজিরার দিন তিনি সব সময় স্যুট নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে বিভিন্ন বিষয় মজা করে বর্ণনা করতেন। তাকে আমরা মুখ কালো করে থাকতে দেখিনি কোনো দিন। হঠাৎ একদিন নাশতার টেবিলে দেখলাম মীর কাসেমের মন খুব খারাপ। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম- ব্যাপার কী? কী হয়েছে? তিনি বললেন- একটি বিষয় চিন্তা করতে করতে রাতে আর ঘুম হলো না। আর সে কারণেই রাত থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। আমরা তার কথায় সিরিয়াস হয়ে গেলাম। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কী নিয়ে সারা রাত চিন্তা করলেন আর কেনোই বা এত মন খারাপ হলো? তিনি মুখ ভার করেই জবাব দিলেন- কাল রাতে একটি জার্নালে পড়লাম সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ড ও অ্যানটার্কটিকার বরফের স্তর বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে। এভাবে গলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশ সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ যদি বিলীন হয়ে যায় তবে, ১৭ কোটি মানুষের কী হবে? আমি পুরো বেকুব হয়ে গেলাম এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম- হায়রে মানুষ! যার নিজের জীবনের যেখানে ঠাঁইঠিকানা নেই, সেখানে তিনি কিনা ভাবছেন অ্যানটার্কটিকার বরফ নিয়ে।
আমার ওয়াক্তের নামাজসহ তারাবির নামাজে তিনিই ইমামতি করতেন। নামাজ শেষে লম্বা মোনাজাত ধরতেন। আমরা ছাড়াও আরো সাত-আটজন সেবক কয়েদি আমাদের সাথে নামাজ আদায় করতেন। প্রতি দিনকার মোনাজাতে বলতেন- ‘হে আমাদের পরওয়ারদিগার। তুমি আমাদের কর্ম, আমাদের মন এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বেখবর নও। আমরা যদি অন্যায় করে থাকি- তাহলে আমাদের বিচার করো। আর যদি অন্যায় না করে থাকি, তবে তোমার রহমতের চাদর দিয়ে আমাদের আচ্ছাদন করে রাখো। তোমার উত্তম ফয়সালা, রহমত ও বরকত সম্পর্কে আমরা যেনো হতাশ হয়ে না পড়ি; এ জন্য আমাদের চিত্তকে শক্তিশালী করে দাও। ইয়া আল্লাহ! আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর কোনো জালেমের জুলুম কোনো দিন তোমার মাহবুব বান্দাদের একচুল ক্ষতি করতে পারেনি। হায় আল্লাহ! তুমি আমাদের তোমার মাহবুব বানিয়ে নাও। আমাদের এই কারাগার থেকে বের করো- তোমার দেয়া নেয়ামত- আমাদের পরিবার পরিজন সন্তানসন্ততিদের নিকট আমাদেরকে ফেরত যাওয়ার তওফিক দাও। এই কারাগারের চার দেয়ালের বেদনা ও অপমান থেকে আমাদের ও আমাদের পরিবারপরিজনকে রক্ষা করো। হে মালিক! বাংলাদেশের প্রতি তুমি রহম করো। দেশের ক্ষমতাসীনদের ন্যায়বিচার করার তওফিক দাও। আর আমাদের বিশ্বাসকে মজবুতি দান করো। তোমার রহমতের আশায় চাতক পাখির মতো আকাশ পানে তাকিয়ে থাকি! তোমার দরবারে হাত পাতি- হে আল্লাহ! তুমি আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করো, আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে অতি উত্তম প্রতিদান দাও এবং সর্বাবস্থায় আমাদের হেফাজত করো। আমিন।’
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য