গুম হওয়াদের পরিবারে অন্যরকম বন্ধন

Slider টপ নিউজ বাংলার মুখোমুখি সারাদেশ

44229_fff

 

ঢাকা; এক সময় তারা পরস্পরের বন্ধু ছিলেন। তাদের এ বন্ধুত্ব পরিবার জানলেও তা পারিবারিক সম্পর্কের দিকে গড়ায়নি কখনো। কিন্তু বন্ধুরা যখন গুম হলেন তখন সেই পরিবারগুলোর মধ্যেই গড়ে উঠলো এক সম্প্রীতির বন্ধন। স্বজন হারানোর কষ্ট ভাগাভাগি করতে গিয়ে এখন তারা আত্মার আত্মীয়। শুধু পূর্ব পরিচিতরাই নয়, গুম হওয়া অনেক অপরিচিত পরিবারও এখন একে অন্যের ঘনিষ্ঠ। কারণে-অকারণে যোগাযোগ হচ্ছে। কেউ তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বজনের সন্ধান পেয়েছেন কিনা অতি আপনজনের মতো সে খোঁজখবরও নিচ্ছেন তারা নিয়মিত। এছাড়া গুম হওয়া যেকোনো পরিবার কোনো উদ্যোগ নিলেই ছুটে যাচ্ছেন সেসব কর্মসূচিতে। কথা বলছেন, একে-অপরের খোঁজখবর নিচ্ছেন, ব্যথিত হচ্ছেন। এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট কোনো প্লাটফর্মও নেই। যেকোনো মাধ্যমে, যেকোনো ভাবে কানে খবর পৌঁছালেই হলো। নিজ দায়িত্বে-নিজ উদ্যোগে অন্যদের জানিয়ে দিচ্ছেন, কর্মসূচিতে চলে আসছেন। এর বাইরেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৪ বন্ধু রাজধানীর নাখালপাড়া এলাকার আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম, রাসেল, বাড্ডার আল-আমিন ও মুগদার রানাকে। ওইদিন রানা নাখালপাড়ায় আসেন। মাসুম ও রাসেলকে বলেন, তাদের বন্ধু আল-আমিনের শরীর ভালো না। এই বলে তারা তিনজন মিলে বাড্ডাতে আল-আমিনকে দেখতে যান। পরে ৪ বন্ধু মিলে ভাটারা এলাকায় ঘুরতে যান। মাগরিবের আজানের আগ মুহূর্তে দেখা হয় তাদের পরিচিত বড় ভাই বিএনপি নেতা সাজেদুল সুমন ও তার খালাতো ভাই তানভীরের সঙ্গে। ওই দু’জন তাদের নিয়ে রাস্তার পাশে চা খাওয়াচ্ছিলেন। এ সময় সেখানে ৪ বন্ধুকে একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আরেকটি গাড়িতে করে তুলে নেয় সুমন ও তানভীরকে। সেদিন থেকেই নিখোঁজ তারা। এরপর সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো নিখোঁজ জিডি করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কোনো হদিস পাননি। তারা জীবিত কি মৃত সে খোঁজও নেই তাদের কাছে। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে ধর্না দিয়েও মেলেনি তাদেন সন্ধান। নিখোঁজ মাসুমের ভাই জানান, শুধু তারা নন, সবার পরিবারই তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে এখনো বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিচ্ছেন। আমরা জানতাম তারা পরস্পরের বন্ধু। ওইটুকুই। এর বেশি সম্পর্ক তাদের সঙ্গে আমাদের ছিল না। কিন্তু এখন সম্পর্কটা অনেকটা পারিবারিক পর্যায়ে গেছে। কারণ তারাও আমাদের মতোই হতভাগা। ভিকটিমদের নিয়ে কোনো প্রোগ্রামের খবর পেলেই আমরা একে অপরকে জানায়। ছুটে যাই। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও অনেক সময় খোঁজ নেয়া হয়। পরিবারগুলোর সঙ্গে অনেকটা আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বলেন, তাদের একজনেরও ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। তাহলে বাকিদের খবরও পাওয়া যাবে। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা নিখোঁজ হয়েছেন এ সংক্রান্ত নানা কর্মসূচিতে তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয়। ব্যক্তিগতভাবেও খোঁজখবর নেয়া হয়। অপর গুম হওয়া রাসেলের বোন লাবণী জানান, তাদের মতো যেসব পরিবারের সদস্যরা গুম হয়েছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো ভেদাভেদ নেই। বিএনপির পারভেজ ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ হয় তেমনি কুমিল্লার ছেলে ছাত্রলীগের সোহেলের বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। তিনি আরো বলেন, সোহেলের বাবা ওই আঙ্কেলও আওয়ামী লীগ করেন এবং তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
সোহেল ওরফে চঞ্চল (৩৪)। চঞ্চল পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য ছিলেন। বংশালের চুরিওয়ালা গলিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। চঞ্চল ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর বিকালে তার চার বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে যান শাহবাগ এলাকায়। ওই সময় চঞ্চলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে চঞ্চল নিখোঁজ। পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধর্না দিয়ে সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। চঞ্চলের পরিবারের সদস্যরা আরো যারা গত তিন বছরের মধ্যে নিখোঁজ হয়েছে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে থাকে। নিখোঁজ পরিবারগুলো একসঙ্গে পুলিশ, র‌্যাব ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের অফিসে যোগাযোগ করে থাকে।  প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে। নিখোঁজদের উদ্ধারের জন্য একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘদিন একই ইস্যু নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠেছে। চঞ্চলের মা বিবি হাজেরা মানবজমিনকে জানান, শুধু আমার ছেলে নয়, গত তিন বছরে অনেকেই গুম হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমার ছেলে গত ৩ বছর ধরে নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। গত ৩ বছর আমাদের মুখে হাসি বলে যে একটা বিষয় আছে তা হারিয়ে গেছে। তিনি আরো জানান, চঞ্চলের সঙ্গে নিখোঁজ কাদের ও  আসাদুজ্জামান রানার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। চঞ্চলের নিখোঁজের দু’দিন পর তারা নিখোঁজ হয়। তারাও আমাদের মতো অসহায়। আমরা তাদের কষ্ট অনুভব করি। আমি যেমন আমার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করি সারাক্ষণ। তেমন করে তাদের মা ও বাবা পরিবার-পরিজন তাদের জন্য সর্বক্ষণ অপেক্ষা করে থাকেন। আমাদের পরিবারে যেমন অভাব-অনটন দেখা দেয় তেমন করে তাদেরও পরিবারে অভাব অনটন দেখা দিয়েছে।
তিনি আরো জানান, আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয়ে যাই। প্রেস ক্লাবসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সংবাদ সম্মেলন করি। গত ৪ঠা ডিসেম্বর একসঙ্গে আমরা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করলাম। এতে করে নিখোঁজ পরিবারগুলোতে একে অপরের একটি সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
চঞ্চলের স্ত্রী লুনা জানান, আমাদের একমাত্র সন্তান হচ্ছে আহাদ। ৩ বছর হলো আমার স্বামী গুম হয়ে আছে। আহাদ তার বাবার জন্য সব সময় কান্না করে। আমাকে সব সময় বলে, আব্বু কখন আসবে। আব্বু কখন আসবে? হৃদয় ভাঙা ভাঙা কথাগুলো শুনে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।
তিনি আরো জানান, চঞ্চলের বন্ধু খালেদের এক সন্তান রয়েছে। আহাদের মতো সেও বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। ওই কথাগুলো আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে আলোচনা হয়। তখন আমাদের মধ্যে এক আবেগপ্রবণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। খালেদ ভাইয়ের স্ত্রীর কষ্টটা আমি অনুভব করি। বুঝতে পারি যে, তাদের কষ্ট আর আমাদের কষ্টের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আমাদের পরিবারের মধ্যে এক সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে। আমরা এখনও আশা নিয়ে বেঁচে আছি যে, আমাদের হারানো স্বজনেরা ফিরে আসবে। আর দশটি মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।
নিখোঁজ হওয়া খালেদ হাসান সোহেলের মা হোসনে আরা জানান, তার ছেলে সোহেল ৩০, জয় চন্দ্র ঘোষ লেন বাংলাবাজার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতো। প্রায় তিন বছর হলো তার ছেলে নিখোঁজ রয়েছে। তার কি অপরাধ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। সংশ্লিষ্ট থানায় কোনো মামলা নেই। সব সময় অপেক্ষায় থাকি- এই বুঝি আমার সন্তান দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। তিনি আরো জানান, মোবাইলে রিং এলে মনে হয় সোহেল ফোন দিয়েছে অথবা সোহেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এইভাবে আর কতদিন চলবে। আর অপেক্ষা করতে পারি না। শুধু সোহেল নয়, আরো অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ওইসব পরিবার আমরা একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করি। খালেদের বন্ধু ছিল চঞ্চল। তাদের দু’জনের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। খালেদের মতো চঞ্চলও নিখোঁজ হয়েছে। আমরা তাদের মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিই। তাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কোনো স্থানে সংবাদ সম্মেলন করলে বা কোনো ব্যক্তির কাছে যোগাযোগ করার জন্য একসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যায়। এতে আমাদের পরিবারগুলোর মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *