বাবাকে সাহায্য করা হলো না আঁখির

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

41651_shromik

 

ঢাকা;  আশুলিয়া এলাকায় রিকশা চালান আশরাফুল ইসলাম। মাথার ওপর পুরো সংসার। দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, নিজের সংসার আর গ্রামে মা-বোন। সব খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। বাবার এই কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না ১৩ বছরে শিশু আঁখির। বাবাকে সাহায্য করতে তাই কাউকে না জানিয়েই চাকরি নেয় সে। গত অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাজে যোগ দেয় আশুলিয়ার ‘কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেড’ নামের একটি গ্যাস লাইটার প্রস্তুতকারী  কোম্পানিতে। এরই মধ্যে ভাঙা মাসের সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনও পেয়েছিল সে। সে টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু বাবাকে আর সাহায্য করা হলো না তার। চলতি মাসের বেতন হাতে পাওয়ার আগেই চির বিদায় নিতে হলো আঁখিকে। মঙ্গলবার কারখানাটিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয় আঁখি। সন্ধ্যার দিকে দগ্ধ আঁখিকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। ওইদিন রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ৩৫ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে আঁখির সঙ্গে দগ্ধ হয়েছে আরো ২৫ জন। দগ্ধদের ২০ জন এখনো ঢামেক বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। যার ১৯ জনই নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ৫ জনকে আইসিইউ’তে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাকিরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি। বার্ন ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, তাদের কারোর অবস্থায় আশঙ্কামুক্ত নয়। অগ্নিদগ্ধ এসব রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রত্যেকেই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের। তাদের ঘিরেই পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে তাদের সে স্বপ্ন যেমন ভঙ্গ হয়েছে, তেমনি কীভাবে চিকিৎসা খরচ জোগাড় হবে তা নিয়েও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। এদিকে সংশ্লিষ্ট কারখানার পক্ষ থেকে এখনো কোনো খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। এ নিয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন।
সূত্র জানায়, কারখানাটির আধা পাকা একতলা ভবনে মঙ্গলবার বিকাল চারটার দিকে আগুন ধরে যায়। মুহূর্তেই আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট প্রায় দু’ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু এর আগেই মালামাল, যন্ত্রসহ কারখানার প্রায় পুরোটাই পুড়ে যায়। ওই সময় কারখানায় কর্মরত শতাধিক নারী ও শিশুর মধ্যে ২৬ জন গুরুতর দগ্ধ হন। আহত হন আরো  কয়েকজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাধীন সনিয়ার (২০) শরীরের ২২ শতাংশ, সখিনার (২০) ৩০ শতাংশ, ফারজানার (১৮) ২০ শতাংশ, হেলেনার (২০) ১২ শতাংশ, মুক্‌ির (১৪) ২০ শতাংশ, শিমুর (৩৫) ২০ শতাংশ, সোনিয়া (১৬) ৩০ শতাংশ, হালিমা (১৫) ২৫ শতাংশ, রকি (১৮) ৭০ শতাংশ, নাজমা (১৬) ২৫ শতাংশ, আয়েশা (১৮) ২০ শতাংশ, হাফিজা (১৬) ২০ শতাংশ, রিনা (২০) ১৫ শতাংশ, মাহমুদা (২৬) ৩০ শতাংশ, মাহিরা (৪০) ৪০ শতাংশ, জান্নাতি (২০) ৩০ শতাংশ, লাভলি (১৭) ৩০ শতাংশ এবং জাকিয়া (১৬)’র ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে।
নিহত আঁখির বাবা আশরাফুল জানান, তিনি আশুলিয়া এলাকায় রিকশা চালান। মেয়ে আঁখি সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছিল। আর ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটি গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ভিকমপুর গ্রামে দাদি ও ফুফুর সঙ্গে থাকে। সেখানেই পড়াশুনা করে। তিনি বলেন, অভাবের সংসার, ঠিকমতো চলে না। আমার কষ্টের কথা চিন্তা করে তাই মেয়েটি বাড়ির কাউকে না জানিয়েই তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে কারখানায় চাকরি নেয়। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সে লেখাপড়া করুক। সে আমার কথা শুনেনি। ভাঙা মাসে আঁখি সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পেয়েছে বলেও জানান আশরাফুল ইসলাম। গতকাল দুপুরেই আঁখির লাশ নিয়ে তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এখনো পর্যন্ত কারখানার কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রকি আক্তারের ভাই জুলফিকার রহমান জনি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বালিয়াদিঘী গ্রামে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রকি সবার ছোট। তাদের বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতো। কিন্তু ৫ বছর আগে তিনি মারা গেলে সংকটের মধ্যে পড়ে তাদের পরিবার। তার মা এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। জনি জানান, তিনি টঙ্গীর সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করছেন। পাশাপাশি একটি পার্ট টাইম কাজ করেন। গত দেড়-দুই মাস আগে তার বোনটি গ্রাম থেকে ঢাকা এসে এই কারখানায় কাজ নিয়েছে। মাসে ৫ হাজার টাকা বেতন। ভাঙা মাসের বেতনও পেয়েছে। আমাকে সে লেখাপড়ায় খরচ দিয়ে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেলো। তিনি বলেন, মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম এমন সময় দুর্ঘটনার খবর পাই। আমি পাগলের মতো ছুটে যাই। গিয়ে দেখি বোনের এই অবস্থা। তার শরীরে ৭০ ভাগ পুড়ে গেছে। রকি হতাশার সুরে বলেন, এখন আমার লেখাপড়ার কি হবে? আর চিকিৎসার টাকা-ই বা যোগাড় করবো কীভাবে? তিনি বলেন, যে কারখানায় চাকরি করতো একবারের জন্যও তারা কোনো খোঁজ নেননি। বলেন, তাদের তো একটু হলেও দায় আছে।
মাহিরা ও হালিমা। একই পরিবারের। তারা দুজনেই দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে মাহিরার ৪০ শতাংশ এবং হালিমার ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। মাহিরা চারমাস আগে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে হালিমাকে পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছে। সেও সংসারের কাজে সাহায্য করার জন্য শাশুড়ির সঙ্গে একই কারখানায় কাজ নেয়। মাহিরার স্বামী ও ছেলে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ময়লা ফেলার কাজ করে। স্বল্প আয়ের এই পরিবারের দুজনই দগ্ধ হওয়ায় তারা এখন দিশাহারা।
এদিকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শঙ্কর পাল জানিয়েছেন, তাদের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন। সরকার দগ্ধদের প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *