রাতুল মন্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর) থেকে: সাহিদা আক্তার স্বর্ণার সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ তাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন। বাল্যবিবাহ রোধ যার প্রধান কর্ম। যেখানেই শোনেন বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে সেখানেই ছুটে আসেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় বেঁচে যায় একটি কিশোরীর জীবন। সমাজের নানা বাধা লাঞ্চনা পেরিয়ে নিজের লক্ষ্য অটুট। বাল্য বিবাহ্ বন্ধ করে এর কারণ কি সেটাও খোঁজে বের করার আ¤্রাণ চেষ্টা করেন তিনি। এক পাঁও পিছন হটাঁতে কারো যেন কোন সাহস নেই। সে তার কাজ করেই চলছে। দারিদ্রতায় বড় হয়েছেন। অর্থকষ্টে থাকলেও জীবনের গতি থেমে থাকেনি তার। পরিবারের প্রবল চাপেও অল্প বয়সে বিয়েতে রাজি হননি। নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে শুরুটা করেছিলেন। এখন তার কার্যক্রম নিজ গ্রাম বা উপজেলা পেরিয়েছে। ২০১৪ সালে নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তার সংগ্রামী জীবনের কথা শুনে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গসহ আগতরা তাকে ‘বাংলার মালালা’ বলে আখ্যা দেন…
স্বার্ণা বলেন, নরওয়েতে যাওয়ার আগে ৬টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করি। ওই সম্মেলন থেকে আসার পর আরও অন্তত ২৫টি বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হই। কখনো শিশুদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে, কখনো সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে কিংবা কখনো প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি। আমার সবচেয়ে সাফল্য হচ্ছে, আমার মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি।
সাহিদা আক্তার স্বর্ণা, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘি গ্রামের হতদরিদ্র মেয়ে। বাবার নাম তোতা মিয়া। দরিদ্র ঘরের সন্তান বলে ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। দরিদ্রতাকে নিজের অদম্য ইচ্ছার শক্তিতে হার মানিয়েছেন এই স্বর্ণা। পড়াশোনা করেন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী স্বর্ণা ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অদম্য সাহসী। নিজে অনেক কষ্ট আর অবহেলায় বড় হয়েছেন বলে দেখেছেন দরিদ্রতার ক্যানভাস। দিনের পর দিন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও। আর তাই তো বোঝেন দরিদ্রতা কী ধরনের অভিশাপ! এর ফলে একজন উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীর কতটা মানসিক স্পৃহা প্রয়োজন।
স্বর্ণার স্পপ্নও কোনো ছোটখাটো স্বপ্ন নয়। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা হতদরিদ্র এবং সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাই তো স্বর্ণা এগিয়ে যাচ্ছেন তার স্বপ্নের কোঠরে। কাজ করছেন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে।
স্বর্ণা কীভাবে এত বড় স্বপ্ন দেখছেন আর কী করে চলে এলেন বাংলার মালালার খ্যাতিতে! অনেকেরই জানার কথা নয়। নরওয়ের অসলোতে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত শিশু ও নারীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও স্বর্ণা অংশ নেন। সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ। সেই সম্মেলনে স্বর্ণা একজন ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ, আর একজন অসহায় মানুষের দুঃখগাথা জীবনের স্মৃতি তুলে ধরেন। আসলে সেই মানুষ আর কেউ নন, সাহিদা আক্তার স্বর্ণা নিজেই। নিজের এই দুঃখেভরা জীবনের করুণ কাহিনীর সঙ্গে তুলে ধরেন এরকম কোটি নিপীড়িত শিশুর জীবনের ইতিহাস। সাহিদা আক্তার স্বর্ণার এই সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ তাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন।
কথায় আছে অভাবে স্বভাব নষ্ট, কিন্তু স্বর্ণা তার ছিটেফোঁটাও লাগতে দেননি নিজের শরীরে। চরম অভাবও কাবু করতে পারেনি তাকে। পারিবারিক চাপ সামলেই বাল্যবিবাহ ভেঙেছেন দুবার। মিশন এখানেই শেষ নয়, এখনো কারও বাল্যবিবাহ হচ্ছে শুনলেই বন্ধ করার জন্য স্বর্ণা হাজির হন দেবদূত হিসেবে। এ জন্য শ্রীপুর উপজেলায় ইয়ুথ অ্যাডভাইজার প্যানেলও গঠন করা হয়েছে।
গল্পটার শুরু এখান থেকেই। স্বর্ণাসহ আরেকজনকে বাছাই করা হয় জাতীয় পর্যায়ে। পুরো বাংলাদেশ থেকে ১৫ জনকে সদস্য নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে স্পেশাল সদস্য হিসেবে নির্বাাচিত হন স্বর্ণা। এ ছাড়াও ব্রিটিশ হাইকমিশনে ইয়ুথ অ্যাডভাইজার হিসেবেও তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বৃক্ষরোপণ, সুস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে করণীয় নিয়ে কাজ করছেন।
বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলার মালালার গল্প:
‘মায়ের মুখে শুনতাম, মেয়ে-সন্তানের চেয়ে বাবা ছেলে-সন্তান বেশি ভালোবাসতেন। ছেলে-সন্তান বংশের বাতি। ছেলে-সন্তানের আশায় আমার মায়ের ঘরে একে একে পাঁচটি মেয়ে জন্ম নেয়। এ জন্য মায়ের ওপর চলত নির্যাতন। অনেক সময় নির্যাতন সইতে না পেরে মা নানাবাড়ি চলে যেতেন। সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। অনেক সময় বাবাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। আবার বিয়ে করবেন বলে ভয় দেখাতেন। বাবা প্রায়ই কারণে-অকারণে মায়ের ওপর হাত তুলতেন। এমনকি সংসারের খরচটা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতেন। যখন আমি আড়াই বছর বয়সের তখন বাবা বিদেশ চলে যান। মা আমাদের নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। অভাবের তাড়নায় বড় বোনের এসএসসি টেস্ট দেওয়ার পরই পরিবারের সদস্যরা জোরপূর্বক বিয়ে দেন। প্রায় ৫ বছর পর বাবা দেশে ফেরেন। ফিরে দুই বছর পর ছেলে-সন্তানের আশায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তখন আমি ৫ম শ্রেণিতে পড়তাম। একপর্যায়ে দ্বিতীয় বোন দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা জোর করে এমন এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন, যে তার নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারে না। অথচ আমার বোন দেখতে ভালো ছিল। যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিলেও ওই স্বামী তাকে মারধর করত। একপর্যায়ে মাসতিনেক পর আপু সংসার ছেড়ে চলে আসে। পরিবারের দুরবস্থায় দশম শ্রেণিতে উঠে লেখাপড়া বাদ দেন তৃতীয় বোন। পরিবারের হাল ধরতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বোন সোয়েটার কারখানায় চাকরি নেন। তাদের রোজগারে নিত্যদিনের খরচ হলেও লেখাপড়ার খরচ অবহেলাতেই থেকে যেত। একটি দরিদ্র ঘরের সন্তান খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারে না কেবল খরচের জন। যখন আমি নবম শ্রেণিতে তখন আমার দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। এ অবস্থায় ছোট বোনও লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরি নেয় এবং তিন-চার মাস চাকরি করে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে আনেন স্বর্ণা। নিজের দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা আমি কখনো ভুলতে পারি না। এরপরই আসে আমার পালা, বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। মায়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন বাল্যবিবাহের জন্য। পাশের গ্রামের এক নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। আমি লেখাপড়া করতে চাই বলে জানাই কিন্তু আমার পরিবার তা মানতে নারাজ। আমার অনেক স্বপ্ন, লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়ে পরে বিয়ে করব। কিন্তু পরিবার থেকে নানা চাপ আসতে থাকে। ঘর থেকে খাবার বন্ধ করে দেয়, পড়তে দেবে না বলে চাপ দেয়। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নানার বাড়ি চলে আসি। ছোট খালা বিএ-তে পড়তেন। তাকে বলি আমি লেখাপড়া করতে চাই, অনুরোধ করি বিয়ে বন্ধ করার।
স্বর্ণার জীবনের নতুন মোড়
২০০৬ সালে প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য হন। শিশুদের নিয়ে কবিতা-গান, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড করত সংস্থাটি। এগুলোতে অংশ নিতেন। এই কর্মকান্ডে অংশ নিলে প্ল্যান বাংলাদেশ একবেলা ভালো খাবার ও ৫০ টাকা যাতায়াত ভাতা দিত। ওই টাকা দিয়ে লেখাপড়ার জন্য খাতা-কলম কিনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করায় ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই বছরই সিংদীঘি শিশুক্লাব গঠন করেন। ২০১৩ সালে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শ্রীপুর উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পান। এরপরই জীবনের আরেকটি স্বর্ণালি অধ্যায় শুরু হয়। নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নেন। যে সব শিশু নানা প্রতিকূলতায় বড় হচ্ছে, নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে, তাদের নিয়ে খবর করে। এ রকম খবর প্রকাশ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা থেকে সেখানে কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান স্বর্ণা। কিন্তু তখন তার বাবা-মা তাকে যেতে দেননি। ২০১৪ সালে নরওয়ের অসলোতে শিশু ও নারীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। ওখানে ৪টি কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন। এক কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ। সেই কনফারেন্সে প্রায় ৪-৫ শ মানুষের উপস্থিতিতে দরিদ্রতার গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ তার সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তাকে পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই-এর তিনজন শুভেচ্ছা দূত, হিউম্যান রাইটসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। শিশুদের সচেতন ও সংগ্রামী করে তোলার গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গসহ আগতরা স্বর্ণাকে ‘বাংলার মালালা’ বলে আখ্যা দেন।
দরিদ্র আর অবহেলা স্বর্ণাকে একজন আদর্শ সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছে। সে এখন অন্য মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণীয় এক আদর্শ। তার মার দাবী সমাজের ধন্যার্থ লোকজন যদি স্বর্ণারমত মেয়েদের পাশে দাড়াঁয় তাহলে তারা এই সমাজ থেকে একদিন চির তরে বাল্য বিবাহ্ শিশু নির্যাতনসহ সকল নারী কেন্দ্রীক সমস্যা সমাধান হবে। তিনি আরো বলেন, ভালো কাজকে সমাজ কখনো মূল্যায়ন করে না তাই আমার মেয়েরমত হাজারও স্বর্ণা অধরায় থেকে যায়।