কোম্পানীগঞ্জে হাওরে নির্মমতা মিললো বাবা-মেয়ের লাশ

Slider জাতীয়

22882_missing

 

রাত তখন ৯টা। ‘টাইয়া পাগলা’ হাওর দিয়ে নৌকায় যাচ্ছেন আবদুস সালাম। সঙ্গে স্ত্রী রোশনা বেগম ও অষ্টাদশী মেয়ে রুনি বেগম। হাওরের এক পাশ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় পথিমধ্যে একটি নৌকায় থাকা তিন যুবক তাদের আটকায়। নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেয়। একটু দূরে যাওয়ার পর আরেকটি নৌকায় থাকা ৫-৬ জন যুবক তাদের নৌকা আটকায়। আবদুস সালামের নৌকার পাশে যুবকরা তাদের নৌকা এনে অষ্টাদশী রুনির দিকে হাত বাড়ায়। যুবকরা রুনিকে তাদের নৌকায় নিতে চাইলে বাধা দেন আবদুস সালাম। এ সময় তিনি চিৎকারও করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে যুবকরা। তারা হাতে থাকা দা ও লাঠি দিয়ে উপর্যুপরি কোপায় আবদুুস সালামকে। তাদের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে পড়েন আবদুস সালাম। ঢলে পড়েন হাওরের পানিতে। আবদুুস সালাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পরপরই মেয়ে রুনিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন মা রোশনা বেগম। এ সময় রোশনার মাথায় পিছন দিকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে যুবকরা। অজ্ঞান হয়ে পড়েন রোশনা। কিছু বলতে পারেননি। রাত ২টায় যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন নৌকার উপর শুয়ে থাকা অবস্থায়। নৌকাটি তার গ্রামের পাশে রাস্তার সঙ্গে ভিড়ানো ছিল। উঠে তিনি স্বামী ও মেয়েকে খুঁজছিলেন। কিন্তু পাননি। কিন্তু ঘটনার পরদিন  রোববার সন্ধ্যায় ‘টাইয়া পাগলা’ বিলেই ভেসে উঠে আবদুস সালামের লাশ। আর রুনির লাশ পাওয়া যায় একই বিলে সোমবার সন্ধ্যায়। আলোচিত এ ঘটনা ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দুর্গম হাওর জনপদ পুটামারা গ্রামে। এ ঘটনায় পুলিশ রাতেই চারজনকে আটক করে। তবে, আলোচিত এ জোড়া খুনের ঘটনায় দুইজনকে গতকাল আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় পুটামারা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হাওর জনপদ কোম্পানীগঞ্জের ইছাকলস ইউনিয়নের পুটামারা। চারদিকে অথৈ পানি। নৌকাই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এ গ্রামের আবদুস সালাম স্ত্রী রোশনা বেগম ও মেয়ে রুনি বেগমকে নিয়ে গত শনিবার আসেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরে। কাজ সেরে বিকাল ৪টার দিকে ভাড়া করা নৌকাযোগে নিজ বাড়ি পুটামারা গ্রামে ফিরছিলেন আবদুস সালাম। আর পথিমধ্যে নিজ গ্রাম পুটামারার পাশেই ‘টাইয়া পাগলা’ বিলে ঘটে এ নির্মম ঘটনা। স্থানীয়রা জানান, ঘটনার দিন রাত ২ টার দিকে রোশনা বেগম বাড়ি ফিরে স্বজনদের কাছে এ ঘটনা জানালে গোটা গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের অনেকেই রাতে তাদের খোঁজে ‘টাইয়া পাগলা’ বিলে নৌকা নিয়ে নেমে পড়েন। কিন্তু তাদের পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরদিন রোববার বিষয়টি জানানো হয় কোম্পানীগঞ্জ পুলিশকে। বিকেলে দিকে পুলিশ গিয়ে গ্রামের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে সন্ধ্যার দিকে বিলের পাশে আবদুস সালামের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, আবদুস সালামের লাশ ছিল অনেকটা ক্ষত-বিক্ষত। তার মাথায় ছিল ধারালো অস্ত্রে আঘাত। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানেও ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। যখন উদ্ধার করা হয় তখন অনেকটা ফুলে গিয়েছিল লাশ। এদিকে, রোববার সন্ধ্যায় আবদুস সালামের লাশ পাওয়া গেলেও রুনি বেগমের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে, গ্রামের লোকজন হাওরের বুকে তাদের খুঁজে ফিরছিলেন। ঘটনার দুই দিন পর সোমবার বিকালে হাওরের পাশে ঘাস লতাপাতা ঘেরা একটি স্থানে রুনির লাশ পাওয়া যায়। খবর পেয়ে কোম্পানিগঞ্জ থানার এসআই রাশেদুল আলম খান পুলিশ দল নিয়ে লাশ উদ্ধার করেন। তিনি গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, রুনির বুকের বাম পাশে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এছাড়া আরও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে শরীরে। তিনি ধারণা করেন, রুনিকে নিয়ে যাওয়ার পর গণ-ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে, সব কিছু পরিষ্কার হবে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের পর। এদিকে, দু’টি লাশ উদ্ধারের পর গতকাল সকালে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। দুপুরে লাশের ময়নাতদন্তের পর গ্রামের বাড়ি পুটামারা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিকালে লাশ দু’টি দাফন করা হয়। এদিকে, এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ সোমবার বিকালে একই গ্রামের আবদুর রব, মেহেরুন নাহার, সালমা বেগম ও ফাহিমাকে আটক করে নিয়ে আসে। রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানা হাজতে রেখে তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের গ্রেপ্তারকৃত মেহেরুন নাহার ও তার মেয়ে ফাহিমা বেগম স্বীকার করেছে আবদুস সালামের সঙ্গে তাদের জমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ ঘটনা রোশনা বেগম রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানায় ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় মেহেরুন নাহার ও তার মেয়ে ফাহিমাকে আসামি দেখিয়ে গতকাল সিলেটের আদালতে প্রেরণ করা হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি বায়েছ আলম মানবজমিনকে জানিয়েছেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দ্রুত রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *